বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কার্যক্রমে যুক্তরাষ্ট্র, তার মিত্রদেশগুলো এবং জাপানের অত্যধিক প্রভাবে নাখোশ হয়ে নতুন বিশ্বজনীন ব্যাংক গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে চীন ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর ৬ জাতি সংস্থা।
চীনের উদ্যোগে নেয়া প্রতিষ্ঠানটির নাম হবে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক বা এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি); যা চলতি বছরের শেষ দিকে ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের তহবিল নিয়ে যাত্রা শুরু করবে।


বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীনের এই উদ্যোগের সঙ্গে বাংলাদেশও সম্পৃক্ত থাকবে। এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত এশিয়ার ২২টি দেশ আগ্রহ দেখিয়েছে। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি সম্পদশালী দেশও রয়েছে। অন্যদিকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ৬ জাতি সংস্থা সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে জোটের পঞ্চম শীর্ষ সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে ব্রিক্স উন্নয়ন ব্যাংক গঠনের বিষয়ে একমত হয়েছেন সদস্য দেশগুলোর নেতারা। এই বৈঠকে ঘোষণা দিয়েছে ব্রিক্স গঠনের। ব্রিক্স জোটে রয়েছে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার মত উদীয়মান শক্তির অর্থনীতির দেশগুলো।
এআইআইবি গঠনের প্রক্রিয়ায় সরাসরি জড়িতদের একজন বলেন, চীন মনে করে, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ যা-ই করে, তাতে তারা তেমন গুরুত্ব পায় না। সে জন্য দেশটির নেতারা নিজস্ব ‘বিশ্বব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এতে তাদের হাতেই থাকে প্রস্তাবিত প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃত্ব।
এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ও ইউরোপের সঙ্গে স্থলপথের সংযোগ স্থাপন এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে অর্থায়ন করাই হবে প্রস্তাবিত এই ব্যাংকের প্রধান লক্ষ্য।

ব্যাংকটিতে সিংহভাগ তহবিলের জোগান দেবে এর মূল উদ্যোক্তা চীন। প্রতিষ্ঠানটি প্রাচীনকালে প্রাথমিকভাবে ইউরোপ ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যিক সংযোগ স্থাপনকারী ‘সিল্ক রোড’-এর মতো নতুন আরেকটি মহাসড়ক নির্মাণের ওপর জোর দেবে। পাশাপাশি চীনের রাজধানী বেইজিং থেকে উপসাগরীয় দেশ ইরাকের রাজধানী বাগদাদ পর্যন্ত সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপনসহ এই অঞ্চলে নানা অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থের জোগান দেবে প্রতিষ্ঠানটি। এআইআইবি সরাসরি এডিবির জন্য চ্যালেঞ্জ হবে দাঁড়াবে বলে মনে করা হচ্ছে। চীনা পরিকল্পনা সফল হলে এআইআইবির তহবিলের পরিমাণ হবে এডিবির ১৬ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের তহবিলের দুই-তৃতীয়াংশের সমান।

৬৭টি সদস্যদেশের সংস্থা এডিবির সবচেয়ে বড় দুই শেয়ারহোল্ডার হলো জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র। তাদের শেয়ার হলো যথাক্রমে ১৫ দশমিক ৭ ও ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ। ১৯৬৬ সালে এডিবির প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় থেকেই এর প্রেসিডেন্ট পদটি রয়েছে জাপানের দখলে। আর চীনের শেয়ার মাত্র সাড়ে ৫ শতাংশ। প্রক্রিয়াটির সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা জানান, চীন তার পরিকল্পনাটি নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া এবং এমনকি ‘শত্র“ প্রতিবেশী’ জাপানের সঙ্গেও আলোচনা করেছে। এশিয়ার অনেক দেশই এতে যোগ দিতে আগ্রহ দেখিয়েছে। তবে কেউ এগিয়ে না এলেও চীন একাই সামনের দিকে যাবে।তবে তারা যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের নেবে না ইতিমধ্যে চীন ১০টি দেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকও সই করেছে। এ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দেশটি ইতিমধ্যে এডিবির সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও চায়না সার্বভৌম সম্পদ তহবিলের সাবেক চেয়ারম্যান জিন লিকুনকে নিয়োগ দিয়েছে। তিনি ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছেন। এডিবির প্রধান তাকেহিকো নাকাও গত মাসের শেষ দিকে সতর্কতার সঙ্গে চীনের এআইআইবি গঠনের প্রস্তাবকে স্বাগত জানান। তবে নতুন ব্যাংকটি শ্রম, পরিবেশসহ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থাগুলোকে অবজ্ঞা করে চলতে পারবে না বলেও সতর্ক করে দেন।
কারণ এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় বিনিয়োগ করতে গিয়ে চীনারা সুশাসনের তোয়াক্কা করে না এবং বিবেকহীনতার পরিচয় দিয়ে থাকে বলে প্রায়শই অভিযোগ ওঠে।
এডিবির পূর্বাভাস অনুযায়ী এশিয়ার অবকাঠামো খাতে এখন থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছরে ৮০ হাজার কোটি ডলার করে বিনিয়োগ প্রয়োজন। অথচ সংস্থাটি বছরে মাত্র এক হাজার কোটি ডলার ঋণ দিয়ে থাকে। এ থেকেই অনুমেয় যে এআইআইবির মতো আরও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সুযোগ রয়েছে।
চীনভিত্তিক বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া (বিএফএ), দ্য ডংচেং ডিস্ট্রিক্ট গভর্নমেন্ট অব বেইজিং, চায়না ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক এক্সচেঞ্জেস ও গ্লোবাল ফাউন্ডেশন অব অস্ট্রেলিয়া যৌথভাবে একটি সেমিনারের আয়োজন করেছে। এতে বাংলাদেশসহ এশিয়ার ৪৮টি দেশ যোগ দিয়েছে।

বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়ার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, সাবেক তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন জানান, এআইআইবি গঠনের প্রস্তাব আসে সর্বশেষ বালিতে অনুষ্ঠিত বোয়াও ফোরামের সম্মেলনে। সেখানেই এআইআইবি গঠনের লক্ষ্যে গঠিত হয় ওয়ার্কিং গ্র“প। 

এদিকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ব্রিক্স ব্যাংক গঠনের ফলে আগামী ২০১৭ সাল নাগাদ খবরদারির ক্ষমতা কমে যাবে বিশ্ব ব্যাংকের। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) আদলে গঠিত হয়েছে নতুন ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ব্রিক্স। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অর্থনৈতিক অবকাঠামো উন্নয়নে সব ধরনের আর্থিক সহায়তা দেবে এই আর্থিক সংস্থাটি। জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর টাকায় পরিচালিত মার্কিন নীতির ধারক বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অতিরিক্ত খবরদারি করে বলে অভিযোগ রয়েছে। ব্যাংক সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছেন, আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে সবসময়েই মার্কিন আর্থিক নীতি অনুসরণ করে। যে কারণে ঋণ গ্রহীতা দেশগুলোর অর্থনীতি থাকে টালমাটাল অবস্থায়। এই অচলায়াতন ভাঙতেই ভারত, ব্রাজিল, চীন, রাশিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকা যৌথমালিকানায় গঠন করেছে ব্রিক্স ডেভেলমপেন্ট  ব্যাংক।
এই অচলায়তনকে কাটিয়ে তুলতে ২০১৭ সালের মধ্যেই প্রাথমিকভাবে ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার মূলধন নিয়ে যাত্রা শুরু করবে নতুন আর্থিক সংস্থাটি। পাঁচটি দেশেরই থাকবে সমান শেয়ার মূলধন। প্রথম ছয় বছর ব্রিক্স প্রধানের দায়িত্বে থাকবে ভারত। চীনের সাংহাই শহরে থাকবে ব্রিক্সের সদর দফতর।
প্রধান তিন উদ্যোক্তা দেশ ভারত, চীন এবং রাশিয়া বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু হওয়ায় ব্রিক্স থেকে সবচেয়ে বেশি আর্থিক সহায়তা পাবে বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছেন, বিশ্বব্যাংকের ঝণ সহায়তা গ্রহনের ক্ষেত্রে যে সব শর্ত থাকে তা কখনোই উন্নয়শীল দেশগুলোর জন্য সহায়ক নয়। যার ফলে আফ্রিকা এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো অর্থনৈতিক ভাবে এখনো আলোর মুখ দেখতে পায়নি। বিশ্বব্যাংকের অতিরিক্ত খবরদারির কারণে শ্রীলঙ্কা এবং মালয়েশিয়া এই সংস্থাটিকে বয়কট করে চলছে দীর্ঘদিন ধরে। ভারত কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর সহায়তা নিলেও কোনোরকম খবরদারি করতে দেয়না। আফ্রিকার অনেক দেশ বিশেষত হাইতি, ঘানা, এবং সোমালিয়া শর্তযুক্ত বিশ্বব্যাংকের ঋণ নিয়ে তাদের আর্থিক অবস্থা চরম বিপর্যয়ের মুখে ফেলেছে।

বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকেও ঋণ সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সময় কঠোর শর্ত জুড়ে দেয় যা আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে অনেকটাই শ্লথ করে দেয় বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। এবিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবীদ ও জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবুল বারাকাত বলেন, বিশ্বব্যাংক জাতিসংঘের সদস্যদের টাকায় পরিচালিত হলেও ঋণ সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে মার্কিন আগ্রাসী নীতি অনুসরণ করে যার ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলো সুবিধা করে উঠতে পারেনা। উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিনিধিত্ব করার জন্য গড়ে ওঠা নতুন একটি আর্থিক সংগঠন। ব্রিক্স যদি বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক মনোভাব নিয়ে বাজারে আসে সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের ওপর থেকে চাপ কমে যাবে। তিনি আরো বলেন যেহেত বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু দেশ প্রথমে এটার দায়িত্বে রয়েছে, যার ফলে সবচেয়ে বেশি সুবিধা আমাদের পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে ব্রিক্স চালু হলে বাংলাদেশের উপর বিশ্বব্যাংকের খবরদারি  বন্ধ হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে, ব্রিক্সের সদর দফতর চীনের সাংহাইয়ে হলেও প্রথম ছয় বছরের জন্য সভাপতির দায়িত্ব পাচ্ছে ভারত। দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় সভাপতি হবে যথাক্রমে ব্রাজিল ও রাশিয়া। তবে তাদের মেয়াদ হবে পাঁচ বছর করে। বোর্ড অব গভর্নস-এর প্রথম প্রধান হবে রাশিয়া। ১০ হাজার কোটি ডলার শেয়ার মূলধনের মধ্যে আপাতত পাঁচটি দেশ সমান মালিকানার ভিত্তিতে হাতে নিচ্ছে মোট পাঁচ হাজার কোটি ডলারের শেয়ার  প্রতিটি দেশের হাতে থাকছে এক হাজার কোটি ডলারের শেয়ার মূলধন। পরে ব্যাংকের সম্প্রসারণ হলে বাকি মূলধনও হাতে নিতে পারবে সদস্য দেশগুলো। ব্রিক্সের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, মালিকানায় থাকা পাঁচটি দেশের অর্থনৈতিক ভীত শক্তিশালী করা। কোনো রকম আর্থিক ঝুঁকিতে পড়লে এই ব্যাংক থেকে নিজেরা সহায়তা নেবে। একই সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে  অবকাঠামো উন্নয়নে সব রকম আর্থিক সহায়তা দেবে ব্রিক্স।

বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ মার্কিন তদারকিতে চলায় অনেক দেশই এই দুটি সংস্থা থেকে প্রয়োজনের সময় তেমন কোনো আর্থিক সহায়তা পায় না।  কোনো কোনো দেশের আর্থিক দুর্বলতার সুযোগে সংস্থা দুটি শর্তের বেড়াজালে মার্কিন আর্থিক নীতি প্রয়োগ করে যা অনেক উন্নত রাষ্ট্রের পছন্দ নয়। যে কারণেই জš§ হলো ব্রিক্স। ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের এমন ধারণা দেশীয় অর্থনীতিবিদদের। ব্রিক্স নামক নতুন এই আর্থিক সংস্থাটি উন্নয়নশীল বিশ্বে মার্কিন চাপ কমিয়ে নতুন অর্থনৈতিক ধারার সূচনা করবে এমন আশা তাদের।

উৎসঃ আমাদেরমানচিত্র
গত ২৮-২৯ এপ্রিল ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে অনুষ্ঠিত হল ষোড়শ সার্ক শীর্ষ সম্মেলন। সার্কের এ রজতজয়ন্তীতে আটটি দেশের সরকার প্রধান ও নয় পর্যবেক্ষক দেশ বা জোটের প্রতিনিধিরা একত্রিত হন হিমালয়ের এ ছোট্ট দেশটিতে। আগের সার্ক শীর্ষ সম্মেলনগুলোর মতই এখানে নানা ইস্যু নিয়ে সরকার প্রধানরা আলোচনা করেছেন, ঐক্যমতও পোষণ করেছেন। স্বাক্ষরিত হয়েছে চুক্তি, এসেছে থিম্পু ঘোষণা। তবে বরাবরের মতই অনেকেই সন্দেহ পোষণ করেন, এসব ঐক্যমত, চুক্তি বা ঘোষণা কি শুধু কাগজে কলমেই থাকবে নাকি বাস্তবে রূপ নিবে। এমনকি শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেয়া সরকার প্রধানদের কন্ঠেও বারবার উচ্চারিত হয়েছে যে দক্ষিণ এশীয় এই জোট এখনো কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে পারেনি।

আঞ্চলিক এ জোটের অসফলতার পেছনে অনেকেই দায়ী করেন ভারতের অনীহাকে। বিশেষ করে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে পারমানবিক প্রতিযোগিতা ও বারবার যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি এ অর্থনৈতিক জোটের বেড়ে উঠায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। তার সাথে সাথে সার্কের সদস্য দেশগুলোর আভ্যন্তরীন সংঘাত, সহিংসতা ও পারস্পরিক অনাস্থাও একটি সফল জোট হিসেবে সার্ককে আত্মপ্রকাশ করতে বাধা দিয়েছে। তবে পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে ভারতসহ সব সদস্য দেশই সার্ককে আরো বেশি কার্যকরী করে তুলতে আগ্রহী হয়ে উঠবে বলে ধারণা করা যায়। বিশেষ করে সাম্প্রতিক এই ষোড়শ সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে সরকার প্রধানরা নানা ইস্যুতে তাদের সদিচ্ছা দেখিয়েছেন। সাক্ষরিত হয়েছে পরিবেশ সহযোগিতা বিষয়ক সার্ক কনভেনশন ও সাফটা সেবা বাণিজ্য চুক্তি। পরিবেশসংক্রান্ত চুক্তির আওতায় পরিবেশ রক্ষা এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সদস্যদেশগুলো একযোগে কাজ করবে। আর সেবা বাণিজ্য চুক্তির আওতায় স্বাস্থ্য, সেবা খাত, যোগাযোগ, কম্পিউটিং, তথ্যপ্রবাহ এবং বিমান যোগাযোগ ও বিভিন্ন সেবা খাতে সার্ক দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়টি থাকছে।
এছাড়া সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়া ফোরাম গঠন, সার্ক গণতন্ত্র সনদ, জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করতে ঐক্যমত ও এসডিএফ গঠনের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বিশিষ্ট নাগরিক ও অনাবাসীদের নিয়ে গঠিত হবে দক্ষিণ এশীয় ফোরাম যার কাজ হবে সার্ককে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি নির্দেশনা দেয়া। এ অঞ্চলের উন্নয়নে সার্কের বর্তমান সংস্থাগুলোকেও অধিকতর কার্যকর করতে দিকনির্দেশনা দেবে এ ফোরাম। বাংলাদেশের প্রস্তাবনা অনুযায়ি দক্ষিণ এশিয়ায় গণতান্ত্রিক সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদারের ওপর গুরুত্ব দিয়ে ‘সার্ক গণতন্ত্র সনদ’ গ্রহণের সিদ্ধান্তও নেয়া হয়েছে।
সার্কের ইতিহাসে এবারই প্রথম আলাদাভাবে একটি বিবৃতি নেয়া হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে নেয়া এ বিবৃতিতে দক্ষিণ এশিয়ার বৈচিত্রপূর্ণ জীববৈচিত্র সুরক্ষা ও পুন:নবায়নযোগ্য জ্বালানী ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। এ অঞ্চলকে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম কার্বন নি:সরণকারী অঞ্চল হিসেবে পরিণত করার আশাও করেছেন নেতারা। তবে তারা গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসে আইনি বাধ্যবাধকতা সংবলিত কোন প্রস্তাব গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছেন।
জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে আলোচিত হয়েছেন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ। এর আগে বিশ্ব সম্প্রদায়ের নজর কাড়তে সমুদ্রের নিচে মন্ত্রিসভার প্রতীকী বৈঠক করে তিনি আলোচিত হয়েছিলেন। আর এবার লিখিত বক্তৃতার কপি বিলি করে পরিবেশ নষ্ট করতে চাননা বলে সবার নজর কাড়েন তিনি। এছাড়া সার্কের অগ্রগতি না হওয়ার পেছনে সার্কের দুই পরাশক্তিকে দায়ী করেন নাশিদ। ভারত ও পাকিস্তানের সহিংসতা ও যুদ্ধ বন্ধ করে নতুন দক্ষিণ এশিয়া গড়ার আহ্বান জানান তিনি।
উল্লেখযোগ্য ছিল সার্ক উন্নয়ন তহবিলের যাত্রা। এ শীর্ষ সম্মেলনে ৩০০ মিলিয়ন ডলার নিয়ে এ অঞ্চলের উন্নয়ন তহবিলের যাত্রা শুরু হলো। এছাড়া এ বছরেই শুরু হচ্ছে দক্ষিণ এশীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম।
মোটের উপর এই ছিল ষোড়শ সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে নেয়া গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো। এসব সিদ্ধান্ত কতটুকু কার্যকর হবে তা ভবিষ্যতই বলে দিতে পারে। তবে ২০১১ সালে মালদ্বীপের সতেরতম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিতে আসার আগে পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে সার্ককে একটি সফল অর্থনৈতিক জোট হিসেবে গড়ে তুলতে এসব অঙ্গিকার বাস্তবায়নে এ অঞ্চলের নেতাদের এখন থেকেই সচেষ্ট হওয়া উচিত।
সার্কের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কটা অন্যান্য সদস্য দেশগুলোর তুলনায় একটু ভিন্ন রকম। ১৯৮৫ সালে সার্ক গঠনের পেছনে বাংলাদেশই প্রধান উদ্যোগ গ্রহন করে আর এজন্য সার্ককে এ দেশেরই ‘ব্রেইন চাইল্ড’ (Brain Child) হিসেবে উল্লেখ করা যায়। তবে বাংলাদেশের উদ্যোগে গঠিত হলেও সার্কের মূল দুই শক্তি হিসেবে বিবেচিত হয় ভারত ও পাকিস্তান। দক্ষিণ এশিয়ার মূল দুই অর্থনৈতিক শক্তি হবার পাশাপাশি আদর্শগত বিরোধ ও চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশ হিসেবে এ দুটি দেশই সার্কের সফলতা ও বিফলতা- দুয়ের পেছনেই অনেকাংশে দায়ি। অর্থনৈতিক, সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে ভারত ও পাকিস্তান প্রভাবশালী, তবে উপযুক্ত নেতৃত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশ এ আঞ্চলিক জোটে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে অনেকেই মনে করেন।
১৯৮৫ সালে যাত্রা শুরু হলেও দক্ষিন এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতা ও অর্থনৈতিক জোট তৈরি করার একটি উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয় মূলত নব্বুই এর দশকের শুরু থেকে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনৈতিক সংস্কারের পদক্ষেপ নেয়া, বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তানে অর্থনৈতিক সংস্কার একটি সফল বাণিজ্যক জোট গঠনে বড় ধরণের সম্ভাবনার জন্ম দেয়। বিশেষ করে এ সংস্কারের ফলে ভারতের বিশাল বাজার অন্যান্য প্রতিবেশি দেশগুলোর জন্য মুক্ত হয়, অপরদিকে ভারতও তার শক্তিশালি অর্থনীতি নিয়ে অন্য দেশগুলোর উপর প্রভাব খাটাতে সক্ষম হয়। এছাড়া, এ সময়ের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমানও নব্বুই এর দশক থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমানে বৃদ্ধি পায়।
পুরো বিশ্বের জনসংখ্যার শতকরা ২৩ ভাগেরও বেশি বা ১.৫ বিলিয়ন মানুষের বাস করে দক্ষিণ এশিয়ায়। কিন্তু পৃথিবীর মোট জিডিপির মাত্র ২.৩ ভাগ দক্ষিণ এশিয়ার। আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান আর শ্রীলঙ্কা – সার্কভুক্ত এই আটটি দেশের অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য ভিন্ন রকমের, তবে সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ দুটি হচ্ছে ভারত ও পাকিস্তান। বিশেষ করে ভারতই সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী অর্থনীতির অধিকারী। পুরো অঞ্চলের মোট জিডিপির ৭৭.৮ ভাগ, বাণিজ্যের ৪০.৩ ভাগ ও বৈদিশিক বিনিয়োগের ৭৫.৮ ভাগই ভারতের দখলে। এছাড়া সব কটি দেশের সাথেই ভারতের সীমান্ত রয়েছে। সে হিসেবে ভারতকে এ অঞ্চলের কেন্দ্রও বলা যেতে পারে। সার্ক অঞ্চলের উপর ভারতের এমন প্রভাব একটি কার্যকরী জোট তৈরির পথে একই সাথে ভালো ও খারাপ দুটি দিকই রয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বিশাল আয়তন ও কেন্দ্রে অবস্থান এ অঞ্চলের জোট তৈরিতে একটি জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। ২০০৬ সালে এ অঞ্চলের মোট জিডিপির পাচ ভাগের চার ভাগই ছিল ভারতের, যেখানে ভুটান ও মালদ্বীপ এর জিডিপি ছিলো একশ ভাগের এক ভাগেরও কম। এমন প্রভাবের কারণে প্রতিবেশি দেশগুলো তাদের বাজার খুলে দিলে ভারতের শক্তিশালি বাণিজ্যের হাতে পর্যুদস্ত হবে, এমন ভাবনা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। এছাড়া ভারতের বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর চাপে ছোট দেশগুলোর প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত বা বন্ধ হয়ে যাবে এমন আশঙ্কাও করেন অনেকেই।
অন্যদিকে ভারতেরও এই আঞ্চলিক জোটকে সফল করার ব্যাপারে এক ধরণের অনীহা দেখা যায়। এর কারণ হিসেবে ভারত অন্যান্য দেশগুলো থেকে সহযোগিতা না পাবার যুক্তি দেখায়। তবে বাংলাদেশ, মালদ্বীপের মত দেশগুলো যখন সার্ককে কার্যকর করার জন্য মুখিয়ে আছে, তখন এ ধরণের যুক্তি গ্রহনযোগ্য নয়। সার্কের মত আঞ্চলিক জোটের মাধ্যমে অন্যান্য ছোট দেশগুলো ভারতের বিরুদ্ধে এক জোট হয়ে ভারতকে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে মেনে নেবে না বা স্বীকৃতি দিতে চাবেনা, এমন ভীতিও ভারতের মধ্যে কাজ করেছে। অনেক সময়ই লক্ষ্য করা যায় যে, ভারতের পক্ষ থেকে দক্ষিণ এশিয়ার পরিবর্তে ভারতীয় উপমহাদেশ শব্দগুচ্ছই বেশি ব্যবহার করা হয়।
তবে আশার কথা হচ্ছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের মনোভাবের অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। আঞ্চলিক জোট হিসেবে সার্কভুক্ত দেশগুলোকে নিয়ে একসাথে কাজ করলে বড় ধরণের বানিজ্যিক সুবিধা পাওয়া সম্ভব বলে ভারত মনে করছে। তবে সার্ককে এগিয়ে নেওয়ার জন্য ভারতের এ ভূমিকা আরো জোরদার ও ইতিবাচক হওয়া উচিত।
নানা কারণেই সার্কের দেশগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক বাণিজ্যের পরিমান মোটেও আশাব্যাঞ্জক নয়। এর পেছনে বেশ কিছু কারণ দায়ী। অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য বা সীমান্ত এলাকায় চোরাচালান একটি বড় সমস্যা। অনেকেই বলে থাকেন সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে অবৈধ বাণিজ্য অনেক সময় বৈধ বাণিজ্যের চাইতে বেশি পরিমানে হয় দাঁড়ায়। সার্কের সদস্য দেশগুলোর উপর ভারতের বিশাল বাণিজ্যের আধিপত্য আরেকটি বড় কারণ। উত্তর আমেরিকা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বা নাফটার ক্ষেত্রে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র সেখানে বড় ধরণের আধিপত্য বিস্তার করে আছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সেখানে যেভাবে অন্যান্য সদস্য দেশগুলোর সাথে বাণিজ্য প্রসারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে সার্কের ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা মোটেই সেরকম সহায়ক নয়। তাই নাফটা একটি সফল বাণিজ্যিক জোট হিসেবে কার্যকরীভাবে আত্মপ্রকাশ করতে পেরেছে কিন্ত সার্ক এখনো তাদের নিজেদের সদস্য দেশগুলোর মধ্যেই বাণিজ্য আস্থা অর্জন করতে পারেনি। ভারতের শক্তিশালি বাণিজ্যিক কোম্পানীগুলোর প্রতি ভীতি, অনাস্থা ও অবিশ্বাস একটি সফল বাণিজ্যিক জোট হিসেবে সার্কের গড়ে না উঠতে পারার একটি বড় কারণ। বাজার মুক্ত করে দিলে টাটা, বিড়লা, আম্বানী গ্রুপের বহুমুখী ও বিশাল বিনিয়োগের চাপে অন্যান্য ছোট দেশের ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর টিকে থাকা অনেকটাই মুশকিল হবে বলে অনেকেরই ধারণা। যেমন পাকিস্তান বা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে টেক্সটাইল ও তৈরি পোশাক খাত সবচেয়ে বড় অর্থ উপার্জনকারী খাত। কিন্তু ভারতের অবাধ প্রবেশ এ দুটি দেশের লাভজনক খাতকে লোকসানি খাতেও পরিনত করতে পারে। তবে ভারতের পক্ষ থেকে এ সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিয়ে ভারত-শ্রীলঙ্কার মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের সফলতাকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হয়। তবে শ্রীলঙ্কার সাথে ভারতের সম্পর্ক ও রাজনৈতিক স্বার্থের সাথে অন্যান্য দেশ যেমন বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্ক চিন্তা করলে একই ফলাফল পাওয়া যায়না। তাই বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও যে একই ধরণের ফলাফল আসবে তা বলা যায়না।
বন্দর ও যোগাযোগ অবকাঠামোর দুর্বলতাকে বাণিজ্যিক জোট তৈরির পেছনে আরেকটি বড় বাধা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। শুল্ক ব্যবস্থার দুর্বলতা, উপযুক্ত ট্র্যানজিটের অভাব, নন ট্যারিফ ব্যারিয়ারের কারণে ব্যবসায়ীদের বড় ধরণের ভোগান্তির শিকার হতে হয়। শুধু যন্ত্রপাতি ও অবকাঠামোগত অভাবই নয়, অতিরিক্ত নিয়মের বেড়াজালেও আটকে রয়েছে এ অঞ্চলের বাণিজ্য। বিশ্ব ব্যাংকের এক জরিপে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে যদি পূর্ব এশিয়ার তুলনায় অর্ধেকও অবকাঠামোগত উন্নতি হয়, তবে আন্ত: আঞ্চলিক বাণিজ্য বাড়বে শতকরা ৬০ ভাগেরও বেশি।

বিশ্বের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়াই সবচেয়ে বেশি ‘প্রোটেক্টেড রিজিওন’ বা বাণিজ্যিক সুরক্ষিত অঞ্চল। এ এলাকায় বাজার সবচেয়ে কম মুক্ত ভারতের। ভারতের গড় শুল্ক হার ৩০.১ ভাগ। মুক্ত বাণিজ্য এলাকা বা সাফটা যত বেশি কার্যকর হবে, এই উচ্চ শুল্কের হার তত কমে আসবে বলে ধারণা করা যায়। এছাড়া, নিজ দেশের বাজারকে প্রভাবমুক্ত রাখতে এ দেশগুলোতে বেশ কিছু নন ট্যারিফ ব্যারিয়ার রয়েছে। কার্যকর বাণিজ্যিক জোট গঠন করতে শুল্ক হার কমানো এবং এসব নন ট্যারিফ ব্যারিয়ার দূর করা জরুরি। এছাড়া রুলস অব অরিজিনও শিথিল করা প্রয়োজন।
এতদিন আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তিতে সেবাখাতকে গুরুত্ব দেয়া হতনা। অথচ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনীতির জিডিপিতে অর্ধেকেরও বেশি অবদান সেবা খাতের। বাণিজ্যিকভাবে সেবাখাতের রপ্তানীকারক হিসেবে দক্ষিণ এশিয়া একটা বড় অবদান রাখলেও এতদিন সার্কে কেন এতদিন এটি গুরুত্বের সাথে দেখা হয়নি তা আসলেই ভেবে দেখার মত বিষয়। তবে আশার কথা হচ্ছে থিম্পু ঘোষণায় এটিকে গুরুত্বের সাথে দেখা হয়েছে এবং এ নিয়ে শেষ পর্যন্ত একটি চুক্তিতে আসতে পেরেছে সার্কের শীর্ষ নেতারা। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো সেবা খাতের উদারিকরণের ব্যাপারে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় দর কষাকষি চালিয়ে যাচ্ছে, তাই নিজেদের মধ্যে নেয়া এ উদ্যোগ ভবিষ্যতের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হয়ে থাকতে পারে।
তবে গত কয়েক বছরে সার্কের মধ্যে নতুন করে এক ধরণের প্রাণ চাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর পেছনে সামিট গুলোতে অংশ নিয়ে রাষ্ট্রপ্রধানরা যে রাজনৈতিক সদিচ্ছার কথা প্রকাশ করছেন সেটা এর পেছনে একটা কারণ হতে পারে। বিশেষ করে মুক্ত বাণিজ্য এলাকা বা সাফটা গঠন একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। এর ফলে আঞ্চলিক বাণিজ্য উদারিকরণ ও সমৃদ্ধ অর্থনীতি তৈরির একটি নতুন সম্ভবনা লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া প্রতিটি সম্মেলনেই জলবায়ু, জ্বালানী, নিরাপত্তা, পানি, সন্ত্রাসবাদ ও পর্যটন নিয়ে আলাপ আলোচনা চলছে। পর্যবেক্ষক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও চিনের অর্ন্তভুক্তি ভবিষ্যতে এ জোটটির আরো শক্তিশালি হবারই ইঙ্গিত দেয়।
সার্কের বাণিজ্যকে আরো গতিশীল করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। সার্কভুক্ত দেশগুলোর শুল্ক ব্যবস্থার প্রক্রিয়া ও ব্যবস্থাপনাকে আরো বেশি সহজ ও সময়োপযোগি করা উচিত। এছাড়া সমুদ্র ও স্থল বন্দরে প্রযুক্তি সুবিধা আরো বাড়ানো উচিত। দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক জোটের বাণিজ্যকে আরো শক্তিশালী করে তুলতে সাফটাকে আরো কার্যকর ও উন্নত করতে হবে। এ লক্ষ্যে পণ্য বাণিজ্য(ট্রেড ইন গুডস), সেবা বাণিজ্য(ট্রেড ইন সার্ভিস)ও বিনিয়োগ ক্ষেত্রে আরো বেশি উদারিকরণ করা উচিত। থিম্পু সার্ক সম্মেলনে এ বিষয়ে যে চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছে তার প্রকৃত ও আশু বাস্তবায়ন জরুরি। এছাড়া সাফটাকে আরো কার্যকর করতে মুক্ত বাণিজ্য শুরু ও নন ট্যারিফ ব্যারিয়ার অপসারণের একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়া উচিত। ধীরে ধীরে স্পর্শকাতর তালিকা(সেনসেটিভ লিস্ট)কমানো এবং তার একটি সময়সীমা নির্ধারণ করাও অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
সার্কভুক্ত দেশগুলোর ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ন ইস্যু হচ্ছে জ্বালানী খাত। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অতি সম্প্রতি বিদ্যুত উৎপাদন, ট্র্যান্সমিশন, প্রযুক্তিগত সহায়তার যে চুক্তি হয়েছে তার সফল বাস্তবায়ন হলে এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশও এ ধরণের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করতে এগিয়ে আসতে পারে। বাংলাদেশের বিদ্যুত ঘাটতি পূরণে নেপালের সাথে চুক্তি করাও জরুরি। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক জ্বালানী চুক্তি করে দেশগুলোর নিজস্ব জ্বালানী সম্পদ অন্য দেশের জ্বালানী চাহিদা পূরণে কাজ করতে পারে। সেক্ষেত্রে নেপালের জলবিদ্যুত ভারত হয়ে বাংলাদেশে সরবরাহ করার জন্য বা ভারত থেকে জ্বালানী আমদানির ক্ষেত্রে এ ধরণের চুক্তি কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। এছাড়া সার্কের দেশগুলোর মধ্যে জ্বালানী ক্ষেত্রে ক্রস-বর্ডার বিনিয়োগও প্রয়োজনীয়।
সার্কভুক্ত দেশগুলো জ্বালানী আমদানির উপর নির্ভরশীল এবং বেশির ভাগ জ্বালানীই আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। আফগানিস্তান সদস্য দেশ হিসেবে এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। বিশেষ করে মধ্য এশিয়া থেকে আফগানিস্তান হয়ে পাইপ লাইনের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ গুলোতে জ্বালানী সরবরাহ হতে পারে। একই সাথে পশ্চিম এশিয়ার সাথে যোগাযোগেও আফগানিস্তান একটি সেতু হিসেবে থাকতে পারে। এ ধরণের অভিন্ন জ্বালানী সরবরাহ ব্যবস্থা দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষ করে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও একটি আত্মবিশ্বাস তৈরির পদক্ষেপ বা ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজার’ হিসেবেও কাজ করতে পারে।
সার্কভুক্ত দেশগুলোতে বেসরকারি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা, সুরক্ষা দেয়া ও বাণিজ্যিক বিবাদের বিচার পাবার মত আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলাও জরুরি। সার্কের একটি নির্দিষ্ট গাইডলাইনও তৈরি করা প্রয়োজন যেখানে সদস্য দেশগুলোর ঐক্যমতের ভিত্তিতে আঞ্চলিক বাণিজ্যের লাভ ও সম্পদের বন্টন কিভাবে হবে, কিভাবে একটি আঞ্চলিক রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক গড়ে তোলা যায় এবং দ্বিপাক্ষিক চুক্তির নানা বিবাদ কিভাবে সমাধান করা যায় তার দিকনির্দশনা থাকবে।
সার্ককে গতিশীল করতে এসব পদক্ষেপ নেয়া অত্যন্ত জরুরি। ইতোমধ্যে অনেক ইস্যুতেই সরকার প্রধানরা নীতিগতভাবে একমত হয়েছেন। সার্কের উন্নতির পেছনে এতদিন প্রধান অন্তরায় থাকা ভারতের মনোভাবেও ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ভারতের নীতি নির্ধারকদের কাছে এটা এখন পরিস্কার যে, ছোট ছোট দেশগুলো মিলে ভারতের বিরুদ্ধ দাঁড়ানোর বা আঞ্চলিক ভারসাম্য তৈরি করার একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে সার্ককে ব্যবহার করা হচ্ছেনা বা ভবিষ্যতেও হবার কোন সম্ভবনা নেই।
গত দুই দশকের অভিজ্ঞতায় এটা পরিষ্কার যে ভারত বাদে অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যের সম্পর্কটা এমন নয় যে তারা একত্রে জোট ভারতের বিরুদ্ধে জোট বাঁধবে। এছাড়া ভৌগলিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার কারণে তারা ভারতের সাথে কোন না কোন ভাবে সম্পর্কযুক্ত। দ্বিতীয়ত, চিন ছাড়া অন্যান্য বিশ্ব শক্তিগুলো দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান শক্তি হিসেবে ভারতকে অনেকটাই মেনে নিয়েছে, বিশেষ করে ১৯৯১ সালের পর ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নতির কারণে। ভারতের গুরুত্ব বিবেচনা করেই পারমানবিক সহায়তা চুক্তি করতে এগিয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। ভারতের প্রতিবেশীদের সাথে ভাল সম্পর্ক তৈরি করে ভারতকে দমিয়ে রাখার কোন ধরণের নীতিও বিশ্ব পরাশক্তিকে গ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছেনা। তাই একটি সফল সার্ক থেকে ভারতের হারানোর বা ভীত হবার মত কোন ধরণের ইস্যুও চোখে পড়েনা।
দক্ষিণ এশিয়ায় চিনের একটা উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে। এ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে ভারত ও চিনের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব লক্ষ্য করা যায়। তাছাড়া, দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কটি দেশের সাথে চিনের বাণিজ্যের পরিমান ভারতের চাইতে বেশি। বিশেষ করে পাকিস্তানের সাথে চিনের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। এ দুটি দেশের মধ্যে ২০০৬ এ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং জ্বালানী, কৃষি, প্রযুক্তিগত সহায়তা, যৌথ বিনিয়োগ ইত্যাদি খাতে বহুমুখি অর্থনৈতিক সম্পর্ক তৈরি হয়। চিনের সাথে পাকিস্তানের এ চুক্তি শেষপর্যন্ত সার্কের জন্য ভালো ফলই বয়ে আনে কারণ ভারত তার নিজের স্বার্থ সম্পর্কে সচেতন হয় এবং সার্কের মাধ্যমে প্রতিবেশি দেশগুলোর সাথে একটি আঞ্চলিক বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক তৈরিতে সচেষ্ট হয়।
গত কয়েক বছরে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের সুবাতাস লক্ষ্য করা যায়। ২৬ নভেম্বর ২০০৮ এ মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলা এ সুসম্পর্ককে কিছুটা বাধাগ্রস্ত করলেও তা আগের মত যুদ্ধংদেহি পর্যায়ে যায়নি। আঞ্চলিক বাণিজ্য উন্নয়ন বা সাফটার কার্যক্রমকে গতিশীল করতে এ দুটি দেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল সম্পর্ক থাকাটা খুবই জরুরি। এ ধরণের সন্ত্রাসী কার্যক্রম যেন সার্ককে তার মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে না পারে সেদিকে নজর দেয়া উচিত। এমনকি সার্কের মত একটি অর্থনৈতিক জোট সফল হলে তা সদস্য দেশগুলোর মধ্যে এক ধরণের আস্থার বন্ধন তৈরি করতে পারে। সন্ত্রাসী কার্যক্রমকে নির্মূল করতে এ ধরণের আস্থা অর্জন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই সার্কের সফলতাই সন্ত্রাসীদের প্রতি উপযুক্ত জবাব হতে পারে।
শুধু ভারতই নয়, পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও সার্কের সাথে সাথে নিজেদের অর্থনৈতিক লাভ অর্জন করতে পারে। বিশেষ করে আফগানিস্তান দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্য এশিয়ার মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে বড় ধরণের অর্থনৈতিক লাভের ভাগিদার হতে পারে। এছাড়া সার্কের মাধ্যমে সদস্য দেশগুলো পুঁজি ও শ্রমের উপযুক্ত ব্যবহার এবং পণ্য ও সেবার অবাধ যাতায়াতের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারে। এছাড়া আঞ্চলিক জোট তৈরি হলে বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমান উল্লেখযোগ্য পরিমানে বাড়বে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইস্যুতে দর কষাকষিতে একটি অভিন্ন অবস্থান নেয়ার জন্য সার্ক ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তন, নানা বিপর্যয়, পানি ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় এক্যবদ্ধ প্রভাব রাখতেও এ ধরণের জোট দরকারি। এ ধরণের সমস্যা কোন দেশের পক্ষে আলাদাভাবে সমাধান করা খুবই মুশকিল এবং শুধু সহযোগিতামূলকভাবেই তা মোকাবেলা করা সম্ভব।
অর্থনীতি ও পরিবেশগত লাভের চাইতে বেশির ভাগ সময়ই এ ধরণের আঞ্চলিক জোট গঠনের পেছনে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাগত কারণ বেশি কাজ করে থাকে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সফল অর্থনৈতিক জোট আসিয়ান গঠনের পেছনে কমিউনিস্ট চিন ভীতি একটা বড় কারণ ছিল। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন গড়ে উঠার পেছনে সোভিয়েত ইউনিয়নের পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর উপর প্রভাবকে উল্লেখ করা যায়। সার্কের ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক সদিচ্ছা একটি বড় ব্যাপার। এই রাজনৈতিক সদিচ্ছার উপরই নির্ভর করবে সার্ক কতটুকু সফল হবে। এ ক্ষেত্রে সন্ত্রাস দমনে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আস্থা তৈরি ও যৌথভাবে অভিন্ন অবস্থান নেয়া একটি বড় ইস্যু হতে পারে।
বহুকাল ধরেই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধন রয়েছে। ব্রিটিশদের শাসনের আগেও অনেক শাসকের কাছেই একই সাম্রাজ্য হিসেবেই এ অঞ্চলটি শাসিত হয়েছে। ব্রিটিশ শাসনের সময় একই অর্থনৈতিক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্যে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ শাসিত হয়। কিন্তু রাজনৈতিক ও আদর্শগত বিরোধ এসব বন্ধনকে অনেকটাই হালকা করে তুলে। বর্তমানে সার্কভুক্ত বেশির ভাগ দেশে অভ্যন্তরীন ও প্রতিবেশী দেশের সাথে বিরোধ একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পারমানবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতা এ অঞ্চলের মানুষকে নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। তাই অঞ্চলে শান্তি নিশ্চিত করতে বড় ধরণের ভূমিকা নেয়া উচিত এই দুই দেশেরই। সেইসাথে সার্কের সংগঠক দেশ হিসেবে বাংলাদেশেরও উচিত উপযুক্ত নেতৃত্বের মাধ্যমে এ আঞ্চলিক জোটকে সামনে এগিয়ে নিযে যাওয়া।
পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে, দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক একতা একটি নতুন কৌশলগত গুরুত্ব বহন করে। এ পরিস্থিতিতে সার্কভুক্ত সকল দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত লাভ অর্জনে একটি বড় অবদান রাখতে পারে সার্ক। এ জন্য সদস্য দেশগুলোর মধ্যে আস্থা অর্জন অত্যন্ত জরুরি। বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় উত্থানের জন্যে একটি শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল ও নিরাপদ দক্ষিণ এশিয়া গড়ে তোলার কোন বিকল্প নেই। আঞ্চলিক জোট হিসেবে পেছনে পড়ে থেকে বিশ্ব বাণিজ্যে যে বড় ধরণের কোন অবদান রাখা যাবেনা তা সার্কভুক্ত দেশগুলোর কাছে এখন অনেকটা পরিষ্কার। তাই নিজেদের অর্থনীতির উন্নতির স্বার্থেই সার্ককে সফল করতে সদস্য দেশগুলোর সচেষ্ট হওয়া উচিত।

সাইমুম পারভেজঃ লেখক: প্রভাষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

 জাতিসঙ্ঘ (রাষ্ট্রসঙ্ঘ) বিশ্বের জাতিসমূহের একটি সংগঠন, যার লক্ষ্য হলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আইন, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক অগ্রগতি এবং মানবাধিকার বিষয়ে পারষ্পরিক সহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করা। ১৯৪৫ সালে ৫১টি রাষ্ট্র জাতিসঙ্ঘ বা রাষ্ট্রসঙ্ঘ সনদ স্বাক্ষর করার মাধ্যমে জাতিসঙ্ঘ বা রাষ্ট্রসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এবং পরবর্তীতে লুপ্ত লীগ অফ নেশন্সের স্থলাভিষিক্ত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে বিজয়ী মিত্রশক্তি পরবর্তীকালে যাতে যুদ্ধ ও সংঘাত প্রতিরোধ করা যায়, এই উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ বা রাষ্ট্রসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হয়। তখনকার বিশ্ব রাজনীতির পরিস্থিতি জাতিসংঘের বা রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাংগঠনিক কাঠামোতে এখনও প্রতিফলিত হচ্ছে। 

জাতিসঙ্ঘ বা রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের ৫টি স্থায়ী সদস্য (যাদের ভেটো প্রদানের ক্ষমতা আছে) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স , যুক্তরাজ্য , রাশিয়া , গণচীন, মেক্সিকো ও তিউনিসিয়া হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৭টি বিজয়ী দেশ। [ তথ্যসূত্র প্রয়োজন] ২০১১ সালের হিসাব অনুযায়ী জাতিসঙ্ঘ বা রাষ্ট্রসঙ্ঘের সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্যা ১৯৩ সদস্য। [১] এর সদর দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে অবস্থিত। সাংগঠনিকভাবে জাতিসঙ্ঘ বা রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রধান অঙ্গ সংস্থাগুলো হলো - সাধারণ পরিষদ , নিরাপত্তা পরিষদ , অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ , সচিবালয় , ট্রাস্টিশীপ কাউন্সিল এবং আন্তর্জাতিক আদালত । এছাড়াও রয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ ইত্যাদি। জাতিসঙ্ঘ বা রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রধান নির্বাহী হলেন এর মহাসচিব। ২০০৭ সালের জানুয়ারি ১ তারিখ হতে মহাসচিব পদে রয়েছেন দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিক বান কি মুন ।

কার্যাবলীঃ

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বিতর্ক সভা হিসেবে বিশ্ব মতামত প্রকাশ করতে পারে। জাতিসংঘ সনদের ১০নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে - সাধারণ পরিষদ জাতিসংঘের সনদের অন্তর্ভূক্ত যে-কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারে। পরবর্তীতে বিভিন্ন শাখায় সুপারিশ প্রেরণ করতে পারে।
বিশ্বশান্তি এবং নিরাপত্তা রক্ষা করাও সাধারণ পরিষদের কাজ। তাই যে-কোন রাষ্ট্র বা সদস্য রাষ্ট্র কর্তৃক শান্তি ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত যে-কোন বিষয় সাধারণ পরিষদে প্রেরণ করা যায়। প্রেরিত বিষয়(গুলো) পরিষদ কর্তৃক পর্যালোচনা করার পর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে প্রেরণ করা হয়।
আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়ন করতে পারে সাধারণ পরিষদ। এমনকি বিভিন্ন রাষ্ট্রের আচার-আচরণ অনুসন্ধান ও পর্যালোচনার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইনের প্রসার ঘটাতে পারে।
এ পরিষদ বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা করে। তাই যে কোন রাষ্ট্র বা সদস্য রাষ্ট্র কর্তৃক শান্তি ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত যে-কোন বিষয় সাধারণ পরিষদে প্রেরণ করা যায়। উক্ত বিষয়ে সাধারণ পরিষদে পর্যালোচনা করার পর নিরাপত্তা পরিষদে প্রেরণ করে।
জাতিসংঘের অন্যান্য শাখার কার্য্যের অনুসন্ধান ও নিয়ন্ত্রণ করে। অন্যান্য শাখাগুলো সাধারণ পরিষদের নিকট বার্ষিক প্রতিবেদন প্রদান করে। সাধারণ পরিষদ উক্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে।
নিরাপত্তা পরিষদের সুপারিশক্রমে যে-কোন রাষ্ট্রকে নতুন সদস্যরূপে গ্রহণ করতে পারে। পাশাপাশি পুরাতন যে-কোন সদস্য রাষ্ট্রকে সাময়িক কিংবা স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করতে পারে।
পরিষদটি কিছু কিছু অর্থ সংক্রান্ত বিষয়ে কাজ করে। জাতিসংঘের বাজেট পাস করা এর অন্যতম কাজ। এছাড়াও, সংস্থার বাজেট পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ অনুমোদন করে। পাশাপাশি সদস্যভূক্ত রাষ্ট্রসমূহের বার্ষিক চাঁদার পরিমাণ স্থির করে।
নির্বাচন সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড সম্পাদন করাও প্রধান কার্যসমূহের একটি। জাতিসংঘের মহাসচিব, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জন্য ১০জন অস্থায়ী সদস্য, আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের সদস্য এবং অছি পরিষদের কতিপয় সদস্য নির্বাচন করা এর অন্যতম দায়িত্ব।
বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার লক্ষ্যে সাধারণ পরিষদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। পারস্পরিক সম্প্রীতি ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক যাতে ছিন্ন হলে সংস্থাটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমে মীমাংসার চেষ্টা করে।


গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থার মধ্যে সংসদীয় গণতন্ত্র বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া, এর বিকাশ ও চর্চাকে দেশ ও জনগণের কল্যাণের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে যাওয়া জাতীয় কর্তব্য হিসেবেই বিবেচিত। আর এ কর্তব্য পালন করার মহান দায়িত্ব মাননীয় সংসদ সদস্যদের। যারা নিয়মিত সংসদে উপস্থিত থেকে, সংসদকে কার্যকর ও প্রাণবন্ত করবেন। 
নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর গণতন্ত্রের ধারায় যখন দেশ ফিরে আসতে শুরু করল, তখন দেশের প্রধান দুটি দলের সম্মতিতেই আবার সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারায় ফিরে এলো দেশ। বিএনপি সরকার গঠনের (১৯৯১-৯৬) প্রথম আড়াই বছর জাতীয় সংসদ ছিল প্রাণবন্ত। তারপরই সংসদ বর্জনের সংস্কৃতি শুরু হলো_ বর্তমানে যা স্থায়ী রূপ নিয়েছে। যখন যে দল বিরোধী দলে থাকে, সে দলই সংসদ বর্জন শুরু করে। সংসদে কথা বলার চেয়ে রাজপথে আন্দোলন করতেই তারা বেশি আগ্রহী। এর ফলে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর নেমে আসে অত্যাচার-নিপীড়নের খড়গ। সরকারের অসহনশীল মনোভাব এবং অসহযোগিতামূলক আচরণের কারণেই বিরোধী দল সংসদে না গিয়ে রাজপথে থাকে। অথচ বিরোধী দলকে সংসদে ফিরিয়ে নেয়ার দায়িত্ব সরকারের ওপরই বর্তায়। কথায় আছে, যে যায় লংকার, সে-ই হয় রাবণ। সরকারে থাকলে এক ধরনের আচরণ আবার বিরোধী দলে থাকলে আরেক ধরনের। এই যে আচরণগত পার্থক্য, এটা সংসদীয় গণতন্ত্র বিকাশের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অন্তরায়। - সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলকে বলা হয় ছায়া-সরকার। দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে ছায়া-সরকারের ভূমিকা কোনো অংশেই সরকারের চেয়ে কম নয়। ছায়া-সরকার সরকারকে সহযোগিতা করবে ও পরামর্শ দেবে। জাতীয় দুর্যোগ ও সঙ্কটে সরকারের সঙ্গে তারাও দেশবাসীর পাশে এসে দাঁড়াবে। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা ভিন্ন। এখানে এক নেত্রীর সঙ্গে অন্য নেত্রীর কথা হয় না, এমনকি মুখ দেখাদেখিও বন্ধ। এমন অবস্থায় বিরোধী দল কীভাবে সংসদে আসবে? পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, আস্থা তৈরি হলে নিজেদের ভেতরে দেশপ্রেম জাগ্রত থাকলে সংসদ বর্জনের সংস্কৃতি চালু হতো না। আসলে আমরা নিজেরাই নিজেদের দেওলিয়াপনার এমন নজির স্থাপন করেছি, যা সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য অশনি সংকেত। ওয়াল্টার বেজইট বলেছেন, 'জাতীয় সংসদ আদর্শ লোকদের এক বিরাট সমাবেশ ছাড়া আর কিছুই নয়।' উন্নত দেশের সংসদ সদস্যদের নীতি-নৈতিকতা, শিক্ষা-দীক্ষা, কর্তব্যবোধ, দেশপ্রেম ইত্যাদি মূল্যায়ন করলে ওই কথার যথার্থতা পাওয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি অগ্রহণযোগ্য ও হাস্যকর। আমাদের মহান জাতীয় সংসদে যারা নির্বাচিত হয়ে আসেন, তাদের যোগ্যতা, নীতি-আদর্শ কী, শিক্ষা-দীক্ষা পরিস্থিতি কেমন, তাদের স্বদেশপ্রেম এবং জনস্বার্থকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা কোন পর্যায়ে_ এসব মূল্যায়ন করলে আমাদের জাতীয় সংসদ আদর্শ লোকদের এক বিরাট সমাবেশ কিনা তা সহজেই উপলব্ধি করা যাবে। অত্যন্ত দুর্ভাগ্য ও পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, আমাদের মাননীয় সংসদ সদস্যরা এসবের কিছুই তোয়াক্কা করেন না। 
তারা সবসময় জাতীয় সংসদকে দেখে আসছেন হেঁয়ালির চোখে। বিরোধী দলের সদস্যরা সংসদে উপস্থিত তো থাকেনই না, উপস্থিত থাকেন না সরকারি দলের সদস্যরাও। দলীয়ভাবে তাদের মধ্যে নীতিগত পার্থক্য থাকলেও ব্যক্তিস্বার্থ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতা একই। গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র হচ্ছে, আত্মবিশ্লেষণ করা এবং আত্মমর্যাদাবোধ নিজের মধ্যে জাগিয়ে তোলা। আমাদের নেতা-নেত্রী, সংসদ সদস্যদের দিকে তাকালে কি এ সত্য প্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণিত হয়। যদি তা-ই হতো, তাহলে জাতীয় সংসদ প্রাণবন্ত ও কার্যকর হতো। সংসদ বর্জনের সংস্কৃতি বন্ধ হতো। মনে রাখতে হবে, গণতন্ত্রের প্রতিষেধক কিন্তু স্বৈরতন্ত্র বা স্বেচ্ছাচারিতা নয়, আরো উৎকৃষ্টতর গণতন্ত্র। ভারতের দিকে যদি আমরা তাকাই, সেখানে বহু মত, বহু দল-গোত্রের বর্ণের দেশ, বহু ভাষার দেশ। দেশ হিসেবে যেমন বড়, জনসংখ্যাও অনেক। রাজনীতিবিদদের মধ্যে ব্যাপক মতপার্থক্য ও বৈরিতা থাকা সত্ত্বেও সে দেশে গণতন্ত্র টিকে আছে এবং সংসদ কার্যকর রয়েছে। জাতীয় সমস্যা সমাধানে সেখানে সর্বদলীয় বৈঠক ডাকা হয়। সরকারি ও বিরোধী দল তাতে সমান ভূমিকা রাখে এবং সঙ্কট মোচনে এগিয়ে আসে। আর আমাদের দেশে সরকারি দল যদি উত্তরে হাঁটে, বিরোধী দল হাঁটে দক্ষিণে। কোনো জাতীয় সঙ্কটে সরকারি দল 'হ্যাঁ' বললে বিরোধী দল বলবে 'না'। এ উত্তর-দক্ষিণ, হ্যাঁ-না'র মধ্যেই আমরা ঘুরপাক খাচ্ছি। 
ঘুরপাক খাচ্ছে সংসদীয় গণতন্ত্রও। দেশ ও জনগণের ভবিষ্যতও এরই মধ্যে আবর্তিত। আব্রাহাম লিঙ্কন বহু আগে বলেছিলেন_ গণতন্ত্র এমনই এক ধরনের সরকার, যা জনগণের এবং জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্যই তৈরি। এ অসাধারণ অথচ সহজ কথাটা অনুসরণ করলেই কিন্তু সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর একটি বড় সমস্যা হচ্ছে_ তারা কোনোভাবেই সমালোচনা সহ্য করতে পারে না। সবসময় সত্য ও বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে চলতে পছন্দ করে। উপেক্ষা করে জনগণকে। এমতাবস্থায় কীভাবে জাতীয় সংসদ কার্যকর হবে, আর কীভাবেই বা দেশের উন্নয়ন ঘটবে। উদার গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি যদি দেশে গড়ে না ওঠে, তা হলে কোনোভাবেই জাতীয় সংসদ কার্যকর হবে না। বিগত দুই দশকের বেশিরভাগ সময় যে সংসদ অকার্যকর থেকেছে, তার প্রধান কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্কীর্ণমনস্কতা ও অসহিষ্ণুতা। তাদের এ ধরনের মানসিকতার পরিবর্তন যতদিন না ঘটবে ততদিন দেশ ও জনগণের জিম্মিদশা কাটবে না। গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র হচ্ছে উদারনৈতিক ও সহনশীল দৃষ্টিভঙ্গি জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। আর এটা ছড়িয়ে দেবে রাজনৈতিক নেতৃত্বই। আমাদের দেশের দিকে অথবা জাতীয় সংসদের দিকে তাকালে সে সত্য কি প্রতিষ্ঠিত হয়। যদি না হয় তবে সংসদ বর্জনের সংস্কৃতি চলতেই থাকবে। যা আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো ধারাবাহিকভাবে করে আসছে। আমরা এ সংস্কৃতির অবসান চাই। দেশ ও জনগণের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই। চার দশকে বাংলাদেশ দাঁড়াতে পারলো না কেন, তার আপন গৌরব, ঔজ্জ্বল্য ও কর্মসুষমা নিয়ে তা এক বিরাট প্রশ্ন। 
বাংলাদেশের মানুষ ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ একটা বিস্ময়কর, পৃথিবীখ্যাত ঘটনা। মাত্র নয় মাসে লড়াকু বাঙালি জাতি পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মরণপণ যুদ্ধ করে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে ইজ্জত দিয়ে, অনেকে চিরতরে পঙ্গু হয়ে দেশ স্বাধীন করেছে। এতো ত্যাগ ও রক্ত দিয়ে পাওয়া স্বাধীন দেশ কেন তিন যুগেও দাঁড়াতে পারেনি- তা রীতিমতো গবেষণার বিষয়। দুর্বল রাষ্ট্রকাঠামোর ওপর দুর্বল গণতন্ত্র দাঁড়ানোর চেষ্টা করলে তার ভার জনগণের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয় এ সহজ কথাটি আমাদের দেশ পরিচালনাকারীরা কখনোই বুঝতে চেষ্টা করেন না। একটি অপার সম্ভাবনার দেশ কেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে, দেশটির কেন এমন হতদ্দশা_ এ প্রশ্ন যে কেউ করতে পারেন। পাশাপাশি এ আক্ষেপও করতে পারেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকলে দেশটির এমন অবস্থা হতো না। আমরা ভাষার মাস পালন করি কিন্তু কার্যক্ষেত্রে বা প্রায়োগিক দিক থেকে বাংলা ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। আমরা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে গর্বিত দৃষ্টিতে দেখি ও মূল্যায়ন করি অথচ ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত স্বনির্ভর বাংলাদেশ আজো গড়তে পারিনি। স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এখনো শেষ করতে পারিনি। মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা পরিবার বিপন্ন ও মানবেতর জীবনযাপন করে। বেঁচে থাকার জন্য অন্যের গলগ্রহ হতে হয়। আমরা মানবাধিকার সংরক্ষণের কথা বলি অথচ প্রতি পদে পদে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। আমরা নারী স্বাধীনতার কথা বলি, কিন্তু ঘরে-বাইরে যেভাবে, যে মাত্রায় নারীরা নির্যাতন, শোষণ, লাঞ্ছনার শিকার, ধর্ষণ-গণধর্ষণের শিকার তা আমাদের অন্তঃসারশূন্য সমাজেরই এক ভয়াবহ চিত্র। নারীর স্বাধীন ইচ্ছা ও স্বপ্নকে আমরা প্রতি মুহূর্তে গলাটিপে হত্যা করি। 
সব মিলিয়ে বাংলাদেশে এখন সংঘাতময় রাজনৈতিক ক্রান্তিকাল চলছে। এ ক্রান্তিকাল বাংলাদেশের জন্য এই প্রথম তা নয়। স্বাধীন জাতি রাষ্ট্র হিসেবে জন্মলাভের পর থেকেই ক্রান্তিকাল চলছে। এ ক্রান্তিকাল দূর করে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুস্থতা কীভাবে রাষ্ট্রের মধ্যে আনা যায় সে ব্যাপারে দেশের রাজনৈতিক দলসমূহ, সরকার কিংবা রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের কোনো উল্লেখযোগ্য তৎপরতা বা উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। এই না পড়ার কারণ বহুবিধ হলেও প্রধানত কারণ হচ্ছে দেশপ্রেমহীনতা ও ক্ষমতার সীমাহীন লোভ। এ লোভ সংবরণ করা দেশের রাজনৈতিক দল কিংবা রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষে সম্ভব নয়। সম্ভব যে নয় তা আমরা দেখে আসছি চার দশক ধরে। যার কারণে দেশে গণতন্ত্রের বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা বাধাগ্রস্ত হয়। ১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। তখন এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে, হিন্দু-মুসলমান আলাদাভাবে দুই দেশে বাস করলে উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। ভাইয়ে ভাইয়ে দাঙ্গা বা সংঘাত রক্তপাত হবে না। পাকিস্তান ভাগ হয়ে যাওয়ার পর বাঙালি মুসলমানরা নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। কিন্তু বছর পেরোতে না পেরোতেই তারা হোঁচট খেল। পূর্ববঙ্গের মানুষ যখন দেখল যে, তাদের শ্রমে-ঘামে উৎপাদিত পণ্য পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং পরবর্তীকালে আবার উচ্চমূল্যে তাদের কাছেই বিক্রি করছে। কী সাংঘাতিক ঘটনা। এরপর থেকেই পূর্ববঙ্গের মানুষের স্বপ্ন ভঙ্গ হওয়া শুরু হলো। তারা স্বাধিকার অর্জনের জন্য লড়াই শুরু করলেন। একটি স্বাধীন সার্বভৌম ভূখ-, একটি পতাকা ও স্বাধিকার অর্জনের জন্য আমরা বাঙালিরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মরণপণ করে রক্তক্ষয়ী অসম যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলাম। 
আমাদের উদ্দেশ্য ছিল একটাই_ জয়ী আমাদের হতেই হবে। এটা ছিল আমাদের জাতীয় অস্তিত্বরক্ষার সংগ্রাম। নয় মাস যুদ্ধের পর ভারতের সহযোগিতায় আমরা জয়ী হয়েছি। জয়ের যে কী আনন্দ, যারা মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশ নিয়েছেন, যারা ত্যাগী ও ভুক্তভোগী তারাই সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছেন। এ যেন দীর্ঘদিন খাঁচায় বন্দি পাখিকে মুক্ত আকাশে উড়িয়ে দেয়া। এ আনন্দ স্বাধীনতার, এ আনন্দ বিজয়ের। এ দেশের মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ করে মাতৃভাষার দাবিতে। '৫২-র ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত পথ বেয়েই আসে স্বাধীনতা, আসে বিজয়। একবার পশ্চিম পাকিস্তানিদের করতলগত হয়ে তাদের শোষণ নির্যাতন অত্যাচার নিপীড়নের নিষ্ঠুর শিকার হয়ে বাঙালির স্বপ্ন ভঙ্গ হলো, আর এবার স্বাধীন দেশেই তাদের স্বপ্ন ভঙ্গ হচ্ছে বারবার। স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের খেলার মধ্যে জনগণের দিন চলে যাচ্ছে_ বাংলাদেশও অতিক্রম করল চার দশক। দেশের যেমন উন্নতি হলো না, তেমনি জনগণের ভাগ্যেরও পরিবর্তন হলো না। এটা জাতি হিসেবে সত্যিই আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। যে করেই হোক বাংলাদেশের এ নাজুক অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। বিদেশ থেকে যে বা যারাই এ দেশে আসেন তারা এ দেশ দেখে মুগ্ধ হন। এ মুগ্ধতা ধরে রাখতে হবে নানামাত্রিক উন্নয়ন ও কর্মসুষমার মাধ্যমে, জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ঘটিয়ে। আমরা দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের কাছে যে কোনো বিষয়ে পরমতসহিষ্ণুতা ও প্রকৃত গণতন্ত্র চর্চা প্রত্যাশা করি। কারণ মন্দের ভালো হিসেবে এ দুটি দলই বাংলাদেশ শাসন করবে। সুতরাং জনগণের ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা বন্ধ করতে হবে। যে কাজ করলে দেশ ও জনগণের মঙ্গল হয় সেদিকেই উভয় দলের মনোযোগ দেয়া উচিত।
 প্রতিহিংসা প্রতিহিংসা ডেকে আনে, ধ্বংস ডেকে আনে ধ্বংস। সুতরাং ধ্বংসাত্মক রাজনীতি পরিহার করে দেশ ও জনগণের কল্যাণে রাজনীতি করাই বুদ্ধিমানের কাজ। তাতে দেশও এগোবে জনগণও রক্ষা পাবে। মালয়েশিয়া ঘুরে দাঁড়ালো, যুদ্ধবিধ্বস্ত ভিয়েতনাম ২৫ বছর যুদ্ধ করে ঘুরে দাঁড়ালো, জাপান আণবিক বোমায় বিধ্বস্ত হয়েও ঘুরে দাঁড়ালো, আমরা পারছি না কেন? এই কেন-র উত্তর অনেক লম্বা। মালয়েশিয়ায় মাহাথির মোহাম্মদের মতো একজন হলধর ছিলেন, আমাদের দেশে কি এমন একজন আছেন? আমরা তো আমাদের হলধরকে সপরিবারে হত্যা করেছি, সেইসঙ্গে হত্যা করেছি গণতন্ত্র, অর্থনীতি ও দেশের উন্নয়ন অগ্রগতিকেও। তাহলে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ কীভাবে গড়ে উঠবে? এসব নেতিবাচক ও অন্ধকার দিককে পায়ে ঠেলে, মাড়িয়ে-ডিঙিয়ে বাংলাদেশকে ঘুরে দাঁড়াতে হবেই। তা না হলে বাঙালির সব আন্দোলন, সংগ্রাম, আত্মত্যাগ, আত্মবিসর্জন বৃথা হয়ে যাবে। বৃথা হয়ে যাবে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও। এসব ব্যাপারে জনসাধারণের পাশাপাশি রাষ্ট্র ও সরকার সচেতন ও উদ্যোগী না হলে বাংলাদেশের ভাগ্য ফেরানো কঠিন। ভাগ্য ফেরানো কঠিন জনগণেরও। তারপরও আমরা তো কঠিনেরে ভালোবাসতে চাই। প্রতিষ্ঠা করতে চাই সংসদীয় গণতন্ত্র। এ ক্ষেত্রে সরকার ও বিরোধী দলের সদিচ্ছা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। 
উৎসঃ যায় যায় দিন 


নিজেকে হয় নাই চেনা

অনেকদিন ধরেই একটা প্রশ্নের উত্তর খুজে ফিরে আসছি। বিশ্বের পরাশক্তি দেশ থেকে শুরু করে চুনোপুটি দেশ পর্যন্ত সবাই গনতন্ত্রের জন্য চিৎকার করে গলা ফাটাচ্ছেন যার অর্থ দাঁড়ায় গনতন্ত্রই হল সকল শান্তির আসল মন্ত্র। কিন্তু বুড়ো আঙ্গুলে কালি লাগিয়ে গোপন ব্যালটে চপ লাগিয়ে আসার পর আপনি আমি কি কি সুবিধা ভোগ করি? অনেক ভেবে চিন্তে আমি কিছুই পাইনা। একবার শিয়ালের কাছে মুরগী বাগা দিয়ে আসার কথা ভাবুন। মুরগীটা যেই না শিয়ালের হাতে দিলেন, ফিরে আসতে না আসতেই দেখবেন আপনার কোন মুল্যই নেই, যতই চিল্লা চিল্লি করুন না কেন ওটা শিয়ালের পেটে যেতে আর কোন বাধাই থাকে না। তাই আমার প্রশ্ন হল গনতন্ত্রের সুবিধাটা কি? কেন গনতন্ত্র? আরেকটি জিনিস ভেবে আমি কুল পাই না।

 দেশের ভবিষ্যতের জন্য একজন যোগ্য নেতা নির্বাচন করতে ভোটের মাধ্যমে সকলেই মত প্রকাশ করেন। এখন এই মতের ক্ষেত্রে একজন মুর্খের মতামতের মুল্য ও একজন পি এইচডি হোল্ডারের মতামতের মুল্য সমানে সমান। এটা কি করে সম্ভব? একজন মুর্খের মতামতের ওজন ও একজন শিক্ষিত লোকের মতামতের ওজন কেন সমান হবে, তাহলে এখানে শিক্ষার দাম কি থাকলো? আর তাছাড়া একজন মুর্খ কি করে বুঝবে কে নেতা হলে দেশের ভালো হবে? আজ অবধি আমাদের দেশের মুর্খরা কি তা সঠিক ভাবে বুঝে দেখাতে পেরেছে? আমেরিকার কথা ভাবুন, বলা হয় বাংলাদেশ তথা স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে গনতন্ত্র এখনও শিশু। কিন্তু আমেরিকায়তো গনতন্ত্র পুর্নতা লাভ করেছে তাহলে সেখানে ভোট দিয়ে আসার পর জনগনের মতামতের কতটুকু মুল্য দেয়া হয়? ইরাক যুদ্ধ, আফগান যুদ্ধ, ইসরাইলি বর্বরতার বিরুদ্ধে সে দেশের আপামর জনগন অনেকদিন থেকেই শক্ত বিরোধিতা করে আসছে। কিন্তু তাদের কথার মুল্যকি তারা পাচ্ছে? সেদেশের সিটিজেনদেরকে প্রশ্ন করলেই পরিস্কার জানতে পারবেন কতটুকু তথাকথিত গনতান্ত্রিক অধিকার তারা পাচ্ছে? সে দেশের সাধারন জনগন বহির্বিশ্বের সম্পর্কে তো দূরে থাক নিজ দেশের পলিটিকাল অসামঞ্জস্যতার সম্পর্কে বলতে গেলে একেবারেই অজ্ঞ। কারন সেদেশের সংবাদ মাধ্যম অনেক স্ট্রিক্টলি ফিল্টার বা নিয়ন্ত্রন করা হয়। যার কারনে এদের সচেতনতা অনেক অনেক কম।

 একবার একটি ডকুমেন্টারিতে দেখেছিলাম আমেরিকার রাস্তায় সাধারন জনগনকে কিছু অতি সাধারন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হচ্ছিল। অধিকাংশ লোকই সে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন নি। যেমন জিজ্ঞেস করা হচ্ছিল একটা ত্রিভূজের কয়টা বাহু বা সাইড থাকে? বিশ্বাস করুন আর না ই করুন। কেউ এর সঠিক জবাব দিতে পারেন নি। এখন প্রশ্ন হল গনতন্ত্রের সুফল কি তারা পাচ্ছে? আরও পরিস্কার করে যে প্রশ্নটি করতে চাই তা হল, আসলেই কি গনতন্ত্রের কোন সুবিধা আছে কী? পরিশেষে পাঠক কুলের কাছে অনুরোধ গনতন্ত্রের সুবিধা ও অসুবিধাগুলো জানিয়ে এ অধমকে ধন্য করবেন এই আশায় পোস্টখানা দিলাম। 

উৎসঃ সামহোয়ারইন ব্লগ।

"১৪৪ ধারা" শব্দদ্বয় সম্পর্কে বাংগালীর অভিজ্ঞতা অনেক পুরনো এবং জানাশুনাও অনেক পুরনো। বাংলা সিনেমার বদৌলতে দন্ডবিধির ৩০২ ধারা সম্পর্কে আমজনতা জানলেও আমাদের আলোচ্য ধারাটা বাংগালী জাতির গোচরীভূত হয় স্বাধিকার আন্দোলনের সময় থেকে। 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ৭ টি ধাপেও অংগা অংগিভাবে জডিত ছিল এই ধারা, এই ধারা ভেংগেই আমরা পেয়েছিলাম বাংলা ভাষা, এবং এই ধারা লংঘনের কারনে রাজপথে রক্তও কম দেই নি। শুধু তাইনা স্বাধীনতার পরেও বিভিন্ন সরকার বিরোধী আন্দোলনে বিরোধী দলের সভা সমাবেশ করার রাজনৈতিক অধিকারকে হরন করার জন্য এই ধারাটিকে এখনও ব্যাবহার করে যাচ্ছি। কাজেই এই ধারার গুরুত্ব আমাদের ব্যাক্তি ও রাজনৈতিক জীবনে অপরিসীম। সম্প্রতি বেগম খালেদা জিয়ার গাজীপুর এর সমাবেশসস্থলে ১৪৪ ধারা জারি করে সরকার আবারও ঝালিয়ে নিল এই ধারার ক্ষমতা আর বেগম জিয়াও ১৪৪ ধারার কথা শুনে আর গাজীপুর মুখো হলেননা। তাহলে এতক্ষনে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন এই ধারার ক্ষমতা কত! কি আছে এই ধারাতে? কেন বিরোধী দলগুলুও এই ধারাকে এত ভয় পায়? এই দুইটা প্রশ্নের জবাব দেয়ার আগে বলে রাখি এই ধারাটি ১৮৯৮ সাল থেকেই এই দেশে বলবত আছে, যদিও বৃটিশরাই এই ধারাটির জনক ছিলেন কিন্তু বৃটিশরা এই ধারাটিকে খুব বেশী ব্যাবহার করেন নি, এই ধারাটির রেকর্ড সং্খ্যক ব্যাবহার হয়েছে যথাক্রমে পাকিস্তান আমলে ও স্বাধিনতার পরে বাংলাদেশ আমলে। এই বার বলি কেন বিরোধী দলগুলু এই ধারাকে এত ভয় পায়! কারন হল, এই ধারা যদি ভংগ করা হয় তবে সরকার বা রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানটি তার সুশিক্ষিত পেটোয়া বাহিনি দিয়ে আইনগত ভাবেই ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, পাখির মত গুলি করে মানুষ মারতে পারে একেবারেই বৈধ ভাবে। আর যারা মারা যাবে তারা শুধুই আইন ভংগকারী হিসাবে মারা যাবে এবং যারা মারা গেলে রাষ্ট্রকে মানবাধিকার লংঘনের ন্যুনতম দায়ও নিতে হয় না।
এবার দেখা যাক কি আছে এই ধারাতে? এই ধারায় মোট ৭ টা উপধারা রয়েছে, এই গুলু একসাথে পড়লে যা দাঁড়াবে তা হল: এই ধারাটির দুইটা রুপ আছে: ১. আদালতগত রুপ ২. অফিসগত রুপ। প্রথমটা আদালতে হয় যাতে আইনজিবিরা উপস্থিত থাকেন তাদের উপস্থিতিতেই আদেশ দেয়া হয়। অপরটা উনারা নিজেরা নিজেরাই সারেন। আদালতের বিষয়টি মোটামূটি আমরা সবাই জানি তাই আমি আলাপ করব এর অফিসিয়াল দিকটি নিয়ে। ১৪৪ ধারা মানে বুঝেনতো? এইটা প্রশাসনের একটা বিশেষ ক্ষমতা যা দিয়ে শান্তি শৃঙ্খলা, জননিরাপত্তা বা গন উৎপাতের দোহাই দিয়ে যেকোন জায়গায়, যেকোন কিছু করতে, যে কাউকে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার ক্ষমতা, এক কথায় বললে প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা দেয়ার ক্ষমতা( সর্বোচ্চ দুই মাস পর্যন্ত)।
এই আদেশটা কে দিতে পারে? যেকোন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অথবা সরকার কতৃক ক্ষমতা প্রাপ্ত যেকোন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ( ধারা -১৪৪)(১)/ ৩৬/৩৭ ততসহ তফসীল ৩ ও ৪ ফৌজদারী কার্যবিধি, ১৮৯৮)। কোন ম্যাজিস্ট্রেট চাইলে যেকোন ব্যাক্তির আবেদনের ভিত্তিতে অথবা স্যু মটো বা স্ব: প্রনোদিত হয়ে এই নিষেধাজ্ঞার আদেশ দিতে পারে। দুইপক্ষকে শুনে অথবা একতরফাও এই আদেশ দেয়া যায়। সাধারনত আদালতে এই বিষয়টি দেখাশুনা করার জন্য যেই ম্যাজিস্ট্রেটটি বসেন উনি কিন্তু জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নয় কিম্বা সাধারন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটও (সরকার কতৃক ক্ষমতা প্রাপ্ত)নন, উনাকে বলা হয় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা এ ডি এম কিন্তু কথা হল আইনেতো এই বিষয়টা দেখার ক্ষমতা উনাকে দেয়া হয় নাই তাইলে তিনি বসেন কিভাবে? উনি বসেন ডিসি সাহেবের নির্দেশে, এখন জানা যাক ডিসি সাহেব এইক্ষমতা কাউকে হস্তান্তর করতে পারেন কি না? ধারা- ৩৭ মতে, সরকার যদি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে এই ক্ষমতাটুকু অন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে হস্তান্তর করার জন্য অথোরাইজেশন দিয়ে থাকে তখন পারবে, এবং এই ক্ষমতা দিয়েই জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব অন্য আরেকজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে এই ক্ষমতাটা অর্পন করতে পারেন।

এখন কথা হল, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা এই ক্ষমতাটা সমগ্র বাংলাদেশে প্রয়োগ করতে পারেন কিনা? উত্তর হল: না। ধারা- ১৪৪(৭) এ বলা হয়েছে, মেট্রোপলিটন এলাকায় এই ধারা প্রযোজ্য নয়। তাহলে মেট্রোপলিটন এলাকায়ই তো এই ধারার বেশী প্রয়োজন কারন রাজনৈতিক দল বা যেকোন সংগঠনের আধিপত্য মেট্রোপলিটন এলাকাতেইতো সবচেয়ে বেশী। গ্রামে গঞ্জে এদের তৎপরতা খুব বেশী দেখা যায়না। যদিও আমাদের দেশের সাংবাদিকেরা মেট্রোপলিটন এলাকায়ও ১৪৪ ধারা জারির খবর পরিবেশন করেন নিয়মিত, বিষয়টি আইন সম্পর্কে ন্যুনতম জ্ঞান না রেখে আইন বিষয়ে সাংবাদিকতার ফলে হয়ে থাকে।

মেট্রোপলিটন এলাকা মানে কি? সবাই সচক্ষে প্রতিদিন মেট্রোপলিটন এলাকা দেখে থাকলেও সাধারন মানুষের মধ্যে মেট্রোপলিটন এলাকা সম্বন্ধে ন্যুনতম ধারনাও নাই। মেট্রোপলিটন এলাকা বলতে কি বুঝায় তা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫২ তে নাই, জেনারেল ক্লজেস এক্টে নাই এমনকি ফৌজদারী কার্যবিধিতেও নাই তাহলে জিনিসটা কি? অনেকে আবার সিটি কর্পোরেশন এর সাথে এইটাকে গুলিয়ে ফেলেন তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই বাংলাদেশে এই মুহুর্তে ১০ টি সিটি কর্পোরেশন থাকলেও মেট্রোপলিটন এলাকা রয়েছে মাত্র ৬ টা, যথা- ঢাকা, চট্রগ্রাম, রাজশাহী, বরিশাল, খুলনা ও সিলেট। তাইলেতো বুঝতেই পারলেন, মেট্রোপলিটন এলাকা আর সিটি কর্পোরেশন এলাকা যে এক না! মেট্রোপলিটন এলাকা তৈরী করা হয় মেট্রোপলিটন পুলিশ আইন দিয়ে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকা তৈরী করা হয়েছে Dhaka Metropolitan Police Ordinance, 1976 এর তফসীল ১ দিয়ে, এই আইনের ধারা- ৪ এ ফৌজদারী কার্যবিধিতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কে দেয়া সমস্ত ক্ষমতাকে বাতিল করা হল এবং ধারা- ২৯ এ পুলিশ কমিশনারকে ক্ষমতা দেয়া হল এই এলাকার মধ্যে সভা সমাবেশ নিষিদ্ব করার, সর্বোচ্চ ৩০ দিনের জন্য, অবশ্য নিষেধাজ্ঞা আরও বাড়াতে হলে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি (sanction) নেয়ার প্রয়োজন আছে।
চট্রগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকা তৈরী করা হয়েছে Chittagong Metropolitan Police Ordinance, 1978 এর তফসীল ১ দিয়ে, এই আইনের ধারা- ৪ এও ফৌজদারী কার্যবিধিতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কে দেয়া সমস্ত ক্ষমতাকে বাতিল করা হল এবং ধারা- ৩০ এ পুলিশ কমিশনারকে ক্ষমতা দেয়া হল এই এলাকার মধ্যে সভা সমাবেশ নিষিদ্ব করার, সর্বোচ্চ ৩০ দিনের জন্য অবশ্য নিষেধাজ্ঞা আরও বাড়াতে হলে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি (sanction) নেয়ার প্রয়োজন আছে।
খুলনা মেট্রোপলিটন এলাকা তৈরী করা হয়েছে Khulna Metropolitan Police Ordinance, 1985 এর তফসীল ১ দিয়ে, এই আইনের ধারা- ৪ এ ফৌজদারী কার্যবিধিতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কে দেয়া সমস্ত ক্ষমতাকে বাতিল করা হল এবং ধারা- ৩০ এ পুলিশ কমিশনারকে ক্ষমতা দেয়া হল এই এলাকার মধ্যে সভা সমাবেশ নিষিদ্ব করার, সর্বোচ্চ ৩০ দিনের জন্য অবশ্য নিষেধাজ্ঞা আরও বাড়াতে হলে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি (sanction) নেয়ার প্রয়োজন আছে।
বরিশাল মেট্রোপলিটন এলাকা তৈরী করা হয়েছে বরিশাল মহানগরী পুলিশ আইন, ২০০৯ এর তফসীল ১ দিয়ে, এই আইনের ধারা- ৪ এ ফৌজদারী কার্যবিধিতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কে দেয়া সমস্ত ক্ষমতাকে বাতিল করা হল এবং ধারা- ৩১ এ পুলিশ কমিশনারকে ক্ষমতা দেয়া হল এই এলাকার মধ্যে সভা সমাবেশ নিষিদ্ব করার, সর্বোচ্চ ৩০ দিনের জন্য, অবশ্য নিষেধাজ্ঞা আরও বাড়াতে হলে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি (sanction) নেয়ার প্রয়োজন আছে।
সিলেট মেট্রোপলিটন এলাকা তৈরী করা হয়েছে সিলেট মহানগরী পুলিশ আইন, ২০০৯ এর তফসীল ১ দিয়ে, এই আইনের ধারা- ৪ এ ফৌজদারী কার্যবিধিতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কে দেয়া সমস্ত ক্ষমতাকে বাতিল করা হল এবং ধারা- ৩১ এ পুলিশ কমিশনারকে ক্ষমতা দেয়া হল এই এলাকার মধ্যে সভা সমাবেশ নিষিদ্ব করার, সর্বোচ্চ ৩০ দিনের জন্য, অবশ্য নিষেধাজ্ঞা আরও বাড়াতে হলে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি (sanction) নেয়ার প্রয়োজন আছে।
এবার বুঝা গেল? ১৪৪ ধারা কি?, মেট্রোপলিটন এলাকা কি? মেট্রোপলিটন এলাকায় কিভাবে নিষেধাজ্ঞা দিতে হয়?

উল্লেখ্য এই পোস্টটির লেখকের পরিচয় খোঁজে পাওয়া যায় নি । 

গ্যাস ও বিদ্যুতের নতুন দাম নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। চলতি ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে শেষ হওয়া কথিত ‘গণশুনানি’র ভিত্তিতে এই দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে নতুন দাম কবে ঘোষণা করা হবে তা এখনো ঠিক হয়নি। দাম বৃদ্ধির গণশুনানির পর রায় দিতে ৯০ দিনের যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে সে অনুযায়ী বিদ্যুতের দাম ৭ জুন-২০১৫ এবং গ্যাসের দাম ১৮ জুন-২০১৫ ঈসায়ী তারিখের মধ্যে ঘোষণা করার কথা। এ হিসেবে আগামি জুন (২০১৫) মাসেই গ্যাস ও বিদ্যুতের নতুন দাম ঘোষণা করা হতে পারে। 

পিডিবি’র একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রতি মাসে গড়ে ৬০০ কোটি টাকা হিসাবে বছরে নিট লোকসান হচ্ছে সাত হাজার ২০০ কোটি টাকা, যার পুরো দায়ই পিডিবি’র উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, সরকার বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দিচ্ছে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছেÑ যে অর্থ সরকার বিদ্যুৎ খাতের জন্য ছাড় করছে তার পুরোটাই দেওয়া হচ্ছে ঋণ হিসেবে। এতে রাষ্ট্রীয় এ প্রতিষ্ঠানটির দায় বেড়ে চলছে। এ পরিস্থিতিতে পিডিবি’র আর্থিক সক্ষমতা ভেঙে যাচ্ছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বর্তমান বিশ্বে জ্বালানি তেলের দাম বাড়েনি। কিন্তু এরপরও বিদ্যুতের দাম কেন বাড়ছে তা বোধগম্য নয়। সাশ্রয়ী জ্বালানির নিশ্চয়তা করতে না পারলে দাম বৃদ্ধির চাপ কমবে না। গ্যাস ও কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গড়ে এখনো দুই থেকে আড়াই টাকা ব্যয় হচ্ছে। কিন্তু তেল পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে ২০ টাকা পর্যন্ত ব্যয় হচ্ছে। এতে গড় বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়ে চলছে। ফলে ব্যয় নির্বাহের অজুহাতেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের সিদ্ধান্ত ছিল সাময়িক সময়ের জন্য। কিন্তু সরকারের মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না হওয়ায় স্বল্পমেয়াদি কুইক রেন্টালই এখন দীর্ঘমেয়াদি রূপ নিচ্ছে। এটার ফলেই বেড়ে যাচ্ছে ভর্তুকি। সরকারের মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য আরো আন্তরিক হতে হবে। দেশি হোক আর আমদানি করে হোক যেকোনো উপায়ে গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উপাদন বাড়াতে হবে। তা হলে গড় উৎপাদন ব্যয় কমবে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আবারো বিদ্যুতের দাম বাড়ানো প্রসঙ্গে পর্যবেক্ষকমহল বিরূপ মন্তব্য করেছে। তাদের অভিযোগ- সরকার এমনিতেই বিদ্যুৎ দিতে পারছে না; তার উপর দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর মাধ্যমে সরকারই চাইছে দেশীয় শিল্প ধ্বংস হয়ে যাক। আর এ সুযোগে দেশীয় শিল্প দখলে করে নেয়ার চেষ্টা করেছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত। সরকারের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা কিছু লোক দেশীয় শিল্প ধ্বংসের চক্রান্ত করছে। তারা পরিকল্পিতভাবে নানা সমস্যা সৃষ্টি করার কারণে দেশীয় শিল্প উদ্যোক্তারা বিপাকে পড়েছে। একদিকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করে লোকসানের ঘানি টানছে; অন্যদিকে নিত্য নতুন সমস্যার মুখোমুখি হয়ে শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করতে হচ্ছে। বিদ্যুতের দাম সহনীয় পর্যায় না থাকলে এদেশে শিল্প থাকবে না, শ্রমিকের কর্মসংস্থান থাকবে না; ফলে বাহিরের দেশগুলো আমাদের শিল্পের স্থান দখল করে নিবে। অভিযোগ উঠেছে, সরকার কৃত্রিমভাবে গ্যাস সঙ্কট সৃষ্টি করে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে মুনাফা বিদেশি কোম্পানীর হাতে তুলে দিচ্ছে ।

পর্যবেক্ষক মহল আরো মন্তব্য করেছে, বর্তমান সরকার জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই এলাহী চৌধুরীকে বিদ্যুৎ খাতকে খুন করে দাফন করার লাইন্সেস দিয়েছে! দেশি প্রতিষ্ঠান বাপেক্সকে গ্যাস উত্তোলনের জন্য স্বাধীনতা দেওয়া হলে দৈনিক ৬০/৭০ মিলিয়ন ঘন ফুট গ্যাস উত্তোলন করা যেত; যাতে করে বিদ্যুৎ উৎপাদ সহজ হতো। তার বিপরীতে সরকার রেন্টাল-কুইকরেন্টালের মতো বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রস্থাপনের মাধ্যমে বিদেশীদের হাতে অতিরিক্ত মুনাফা তুলে দিচ্ছে। ১০ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়লে দ্রব্যমূল্য ৩০% বৃদ্ধি পেয়ে জনগণের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।

অথচ দেশের দীর্ঘমেয়াদী বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোর যথাযথ সংস্কার ও নতুন কেন্দ্র স্থাপন করা গেলে স্বল্প মূল্যে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হতো। এতে সরকারের ভর্তুকির পরিমাণ হ্রাস পেত। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যথাযথ উদ্যোগ নেয়া হয়নি। সরকারের এধরনের কর্মকান্ডের ফলাফলে দ্রব্যমূল্য, পরিবহন ব্যয়সহ একদিকে জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে সমস্ত উৎপাদনী খাতের উপরে মারাত্মক কুপ্রভাব ফেলছে। সরকারের এই ধরনের গণবিরোধী তৎপরতা যেকোনো মূল্যে প্রতিহত করা দরকার। এ ব্যাপারে জনগণকেই এগিয়ে আসতে হবে।


হিংসা-প্রতিহিংসার নোংরা রাজনীতির খেলা সর্বত্র বিরাজমান। যে খেলার শুরুটা নিরুত্তাপ হলেও শেষ পরিণতি খুবই ভয়াবহ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি। এমন পরিস্থিতিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্যাট ইস্যুটি অন্যায়, জুলুম, সংবাদের ভিড়ে ভাটা পড়ে গেছে। 

আমরা সবাই কম-বেশি বহু ধারার শিক্ষাব্যবস্থার কুফল ভোগ করছি। বিতর্ক এড়িয়ে জনহিতকর ও বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলন করতে না পারার ব্যর্থতা আমরা দূর করতে পারিনি। এর মধ্যে আবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার ওপর ভ্যাট আরোপ করা মানে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আমাদের সব শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ পাচ্ছে না। এবারের ফলবিপর্যয় হওয়ার পরও দেখা গেছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পরিমাণ আসন রয়েছে তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি পাস করেছে। সব শিক্ষার্থী তো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাবে না। যারা সুযোগ পাবে না তারা কী করবে? পড়ালেখা ছেড়ে দেবে নাকি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করবে? রাষ্ট্র যদি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে লাখো-কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে পারে তাহলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাট কেন প্রত্যাহার করতে পারবে না। এ রকম প্রশ্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের। আমরা আশা করি সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের এ ব্যাপারে বোধোদয় হবে।

বিশ্ববিখ্যাত ফরাসি নাট্যকার ও হাস্যরসিক মলিয়ার (১৬২২-১৬৭৩) একবার সেরবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপককে গল্প শোনাচ্ছিলেন। গল্পটা এ রকম : “এক গণ্ডমূর্খ ধনী জমিদার প্যারিস থেকে অল্প দিনের জন্য গ্রামের বাড়িতে এসেছেন। নিজের প্রিয় ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে তিনি গ্রামে বেড়াতে বের হয়েছেন। রাস্তার ধারে এক নতুন বাড়ি দেখে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। সেখানে অনেক ছেলেমেয়ের ভিড় দেখে তার কৌতূহল হলো। একটি ছেলেকে ডেকে তিনি রাজকীয় গাম্ভীর্যভাবে জিজ্ঞেস করলেনÑ ‘এখানে কী হচ্ছে’? ছেলেটি বলল, এটা বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে হাজার ফ্রাঁ (ফরাসি মুদ্রা) জমা দিলে পিএইচডি পাওয়া যায়। যারা হাতে বা পায়ের বুড়ো আঙুলে টিপছাপ দিতে পারে তারা এক হাজার ফ্রাঁ জমা দিলেই ডিগ্রি পেয়ে যায়। জমিদার তো বেজায় খুশি হয়ে ভেতরে গেলেন। কড়কড়ে নতুন এক হাজার ফ্রাঁ জমা দিয়ে ভিসির কাছ থেকে টিপছাপ দিয়ে ডিগ্রি নিয়ে এলেন। বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎ তার মনে হলোÑ হায়! আমি কী বোকা, আমার ঘোড়ার জন্যও তো একটি ডিগ্রি আনতে পারতাম। যেই ভাবা সেই কাজ, ফিরে গিয়ে ভিসিকে বললেন, এই নিন আরো এক হাজার ফ্রাঁ আমার ঘোড়া আশা করি অন্তত পায়ে টিপছাপ দিতে পারবে, সুতরাং তাকেও একটি ডিগ্রি দিন। কিছুক্ষণ জমিদারের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে অবশেষে ভিসি বললেন, স্যরি আমরা শুধু গাধাদেরই ডক্টরেট দিয়ে থাকি, ঘোড়াদের দিই না।” 

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সুনামের চেয়ে দুর্নামের পাল্লা একটু হলেও বেশি। তাই বলে সব বিশ্ববিদ্যালয় যে শুধু ডিগ্রি বিক্রি করছে তা কিন্তু নয়। অস্বীকার করার উপায় নেই, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশির ভাগই অযৌক্তিক মাত্রায় টিউশন ফিসহ নানা কায়দায় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে উচ্চহারে অর্থ আদায় করে থাকে। তবে সব বিশ্ববিদ্যালয়কে একই পাল্লায় পরিমাপ করা সঠিক হবে না। সংখ্যায় একেবারে নগণ্য হলেও কিছু বিশ্ববিদ্যালয় সত্যিকার অর্থেই শিক্ষার মান ধরে রাখার চেষ্টায় নিয়োজিত রয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে টাকার বিনিময়ে সার্টিফিকেট বিক্রির। কিন্তু সবাই তো সার্টিফিকেট বিক্রি করছে না। আমার মনে হয় ঢালাওভাবে সব কিছু একপেশে করে গুলে ফেলার যৌক্তিকতা নেই। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য লেনদেনকৃত অর্থের ওপর ভ্যাট আরোপ করা হলে হাজারো শিক্ষার্থীকে তার মাশুল গুনতে হবে। বাংলাদেশ এখনো শিক্ষার কাক্সিত মানে পৌঁছতে পারেনি। যেখানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়ানো দরকার, সেখানে ৭.৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা উচ্চশিক্ষার অন্তরালে একটি বড় বাধা। উচ্চবিত্ত পরিবারের পক্ষে এই ভ্যাট প্রদানে সমস্যা না হলেও নিতান্ত গরিব পরিবার থেকে আসা শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন হয়ে পড়বে অনিশ্চিত।

নিকট অতীতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আরোপিত ভ্যাট কিছুতেই কমানো হবে না। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, তারা ৫০ হাজার ৩০ হাজার টাকা বেতন দিতে পারে। আর মাত্র সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট কেন দেবে না? এটা হতে পারে না। তাদের আন্দোলনে আমার কোনো সমর্থন নেই। চলতি বছর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ওপর আরোপিত ৭.৫% ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।

সংবিধানের ১৫ নং অনুচ্ছেদে শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার বলা হলেও এবার বাজেটে এ খাতে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে, যা সংবিধান পরিপন্থী। যেখানে শিক্ষার দ্বিগুণ বাজেট বরাদ্দ দেয়ার কথা, সেখানে এ বছর বাজেটে শিক্ষা খাতে মোট জিডিপির ২ দশমিক ১৮ ভাগ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার জন্য ভ্যাটমুক্ত শিক্ষার বিষয়টি ভেবে দেখার এখনই সময়। 
tofazzul1982@gmail.com - See more at: http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/49395#sthash.nV8N8S0e.dpuf

এবিসি রেডিওর স্টুডিওতে প্রথম আলো জবস ‘হতে চাই পেতে চাই’ অনুষ্ঠানে গত ২৬ এপ্রিল এসেছিলেন হোমবাউন্ড প্যাকারস ও শিপারস লিমিটেডের কর ও আইনবিষয়ক ব্যবস্থাপক মো. আরশেদ আলী। কথা বলেছেন কথাবন্ধু লিনার সঙ্গে। ইনকাম ট্যাক্স অর্থাৎ আয়কর ও ভ্যাট অর্থাৎ মূল্য সংযোজন করের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন।

কথাবন্ধু: ট্যাক্স ও ভ্যাট এই দুটির মধ্যে তফাত কী?
মো. আরশেদ আলী: ইনকাম ট্যাক্স অর্থ আয়কর এবং ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স সংক্ষেপে ভ্যাট অর্থাৎ মূল্য সংযোজন কর (মূসক)। একটি প্রতিষ্ঠান, একজন চাকরিজীবী অথবা একজন ব্যবসায়ীর নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে যে আয় হয়, তার ওপর সরকারকে নির্দিষ্ট কর দিতে হয়। তবে ট্যাক্স ও ভ্যাট দুটি শব্দের তফাত রয়েছে। নির্দিষ্ট আয়ের ওপর যে কর দেওয়া হয়, তাকে বলে আয়কর। আর ভ্যালু অ্যাডিশন অর্থাৎ একটি পণ্যের জন্য যে মূল্য সংযোজন করা হয়, এর ওপর যে করটা দিতে হবে, তাকেই ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স বা সংক্ষেপে ভ্যাট বলা হয়। 
কথাবন্ধু: বাংলাদেশে কোন কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই বিষয়ে পড়ার সুযোগ রয়েছে?
মো. আরশেদ আলী: সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ বিষয়ে পড়ার সুযোগ রয়েছে। বিকম পাস কোর্সে, বিকম অনার্স, বিবিএ, অ্যাকাউন্টিং বিভাগে পড়াশোনা করলে আয়কর বিষয়টি এরই মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকে। যাঁরা বিবিএ ও আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন, তাঁরাও আয়কর বিষয়টি পড়ছেন। কিন্তু ভ্যাট বিষয়টি আমাদের দেশের শিক্ষাক্রমে খুব একটা দেখা যায় না। 
কথাবন্ধু: বাংলাদেশে কর বিষয়টির গুরুত্ব এবং চাকরির ক্ষেত্রগুলো কী কী?
মো. আরশেদ আলী: বাংলাদেশে এ বিষয়টির ব্যাপকতা অনেক। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আয়কর ও মূল্য সংযোজন করের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই প্রতিটি প্রতিষ্ঠান, ছাত্র বা নাগরিক যে-ই হোন না কেন, সবাইকে আয়কর ও মূল্য সংযোজন কর সম্পর্কে জানা উচিত। বর্তমানে অনেকে আয়কর দিতে আগ্রহী কিন্তু তাঁরা জানেন না আয়কর কোথায় ও কীভাবে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রটিতে চাকরির সুযোগ অনেক। এ ক্ষেত্রে মানবসম্পদ বিভাগে যোগ্যতাসম্পন্ন লোকের দরকার রয়েছে। তাই ট্যাক্স ও ভ্যাটের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে চাকরির সুযোগ অনেক বেশি। 
কথাবন্ধু: পড়াশোনা শেষে চাকরির শুরুতেই এই বিভাগে কী ধরনের কাজের সুযোগ রয়েছে?
মো. আরশেদ আলী: আপনি যদি দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন হন, তাহলে চাকরির শুরুতেই আপনি প্রাথমিক পর্যায়ে নয়, নির্বাহী পদেও কাজ করতে পারেন। এ জন্য আপনাকে আইন সম্পর্কে জানতে হবে। কীভাবে আয়কর ও মূল্য সংযোজন কর জমা দেবেন। সবকিছুই আপনাকে জানতে হবে। চাকরির ক্ষেত্রটি অনেক বড়। 
কথাবন্ধু: বাইরের দেশের সঙ্গে আমাদের দেশের এ বিষয়ে কোনো তফাত রয়েছে কি না?
মো. আরশেদ আলী: আইনের ক্ষেত্রে এর কোনো পার্থক্য নেই। বিষয়বস্তু ও বৈশিষ্ট্যগুলো একই। কিন্তু আমাদের দেশে ভ্যাটের পরিমাণ, কীভাবে জমা দেবেন, কত টাকা জমা দেবেন—এসব ব্যাপারে পার্থক্য রয়েছে। বাকি সবকিছু প্রায় এক রকম।
কথাবন্ধু: বাংলাদেশে কোনো ব্যবসা করতে গেলে আয়কর ও ভ্যাটের বিষয়কে কতটুকু প্রাধান্য দেওয়া উচিত?
মো. আরশেদ আলী: এখানে শুধু চাকরি পর্যায়ে নয়, প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন রকম করের পরিমাণ নির্ধারণ করা আছে। কোথায় কী ধরনের কাগজপত্র দরকার, কোথায় জমা দেবেন, কীভাবে জমা দেবেন—এগুলো জানতে হবে। রেজিস্ট্রেশন ও মূসক চালান সম্পর্কে জানতে হবে। তাই প্রতিষ্ঠানগুলোতে এ ব্যাপারে দক্ষ ও যোগ্য কর্মী নেওয়া উচিত।
কথাবন্ধু: পেশা হিসেবে কেউ এই বিষয়ে কাজ করতে চাইলে তাঁর ক্ষেত্রে করণীয় কী?
মো. আরশেদ আলী: আয়কর ও ভ্যাট আইন যদি কেউ অনেক ভালো জানেন, তাহলে তিনি এ পেশায় অবশ্যই আসতে পারেন। এ জন্য অভিজ্ঞতার প্রয়োজন রয়েছে। এ ছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) দেওয়া সনদ থাকলে তা অবশ্যই সম্ভব। এনবিআরে পরীক্ষা দিতে পারেন। যদি পাস করেন তাহলে এনবিআর আপনাকে আইটিপি হিসেবে একটি সনদ দিয়ে থাকে। তখন তাঁরা আয়কর নিয়ে প্র্যাকটিস করতে পারেন। এ ছাড়া ভ্যাট আইনেও এনবিআর বিজ্ঞপ্তি দেয়। যদি কেউ পাস করেন, তাহলে তাঁকে ভ্যাট কনসালট্যান্ট হিসেবে এনবিআর লাইসেন্স দেয়। তাই কেউ যদি চাকরি না করে একে পেশা হিসেবে নিতে চান, তাহলে এর ক্ষেত্রটি অনেক বড় পরিসরে রয়েছে। আয়কর ও মূল সংযোজন কর সম্পর্কে সবারই পর্যাপ্ত পরিমাণ ধারণা থাকা উচিত।
কথাবন্ধু: কোনো প্রশিক্ষণ নেওয়ার প্রয়োজন আছে কি?
মো. আরশেদ আলী: শুধু সাধারণ পড়াশোনা নয়, এ জন্য অবশ্যই প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। এর কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য প্রথম আলো জবস এবং আরও কিছু প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ের ওপর কিছু প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকে। তাই এ বিষয় নিয়ে কাজ করতে হলে অবশ্যই এ প্রশিক্ষণগুলো নেওয়া উচিত। আর অনেক বেশি পড়তে হবে। যত শিক্ষা তত জ্ঞান।
কথাবন্ধু: বর্তমান প্রজন্মকে এই বিষয়ে আরও উদ্বুদ্ধ করতে আপনার দিকনির্দেশনা কী হবে?
মো. আরশেদ আলী: বর্তমান প্রজন্মকে বলব, সততার সঙ্গে কাজ করুন। নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করুন। বেশি বেশি বই পড়ুন। পড়ার কোনো বিকল্প নেই। যত বেশি পড়াশোনা করবেন তত বেশি জ্ঞানার্জন করবেন। যাঁর কাছে জ্ঞান অস্ত্র যত বেশি থাকবে, সাফল্য তত দ্রুত তাঁর কাছে এসে পৌঁছাবে।
গ্রন্থনা: সুদীপ দে


বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বহুসংখ্যক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিন যাবত বসবাস করে আসছে। বাঙালিদের সাথে একই ভৌগলিক সীমারেখার মধ্যে বসবাস করলেও এই সব জনগোষ্ঠীর প্রত্যেকেরই রয়েছে আলাদা আলাদা ভাষা, ঐতিহ্য, সাহিত্য, লোকগাথা, সাংস্কৃতিক চর্চা ও স্থানীয় জ্ঞান। আদিবাসীদের নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চার মধ্য দিয়ে এদেশের সংস্কৃতি বহুমাত্রিকতা লাভ করেছে। কিন্তু বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বহুমাত্রিক ক্ষমতা চর্চার নেতিবাচক প্রভাবে আদিবাসীদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি আজ বিপন্ন প্রায়। কিন্তু ‘আদিবাসী অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র’- শীর্ষক সনদের ৩নং ধারায় বলা হয়েছে, আদিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার রয়েছে এবং এই অধিকার বলে আদিবাসীরা স্বাধীনভাবে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান ও মর্যাদা নির্ণয় এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়নে কাজ করতে পারে (সংহতি, ২০০৭: ৮৯-৯০)। তথাপি বাংলাদেশে বাঁধ, সংরক্ষিত এলাকা, পার্ক, প্রতিবেশ-পর্যটন, সামাজিক বনায়ন, জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের মাধ্যমে আদিবাসীরা উন্নয়নের নামে উচ্ছেদ, প্রতারণা, ক্ষতির সন্মুখীন হচ্ছে এবং বনের আদিবাসীদের এখনো বলা হচ্ছে পরিবেশ উদ্বাস্তু (প্রাগুক্ত, পৃ-৮৯-৯০)। অন্যদিকে জাতিসংঘ মনে করে আদিবাসীদের জীবন-সংস্কৃতি ছিল পরিবেশের জন্য ভারসাম্য ও বন্ধুত্বপূর্ণ (প্রাগুক্ত, পৃ-৮৭)। প্রজন্মান্তরে আদিবাসী জনগণ বিশ্ব পরিবেশকে সমৃদ্ধ করছে।

বিশ্বের ৫টি মহাদেশের প্রায় ৭০টি দেশে কমপক্ষে ৫০০০ স্বতন্ত্র আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর প্রায় ৩৭ কোটি আদিবাসী বসবাস করছে (সংহতি, ২০০৩:৩৮ ও আদিবাসী মানবাধিকার রির্পোট, ২০০৮:১০)। পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসীদের মত দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশগুলোতে বসবাসকারী বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নিজেদের অস্তিত্ব ও স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ক্ষেত্রবিশেষে আজ বিলোপসাধনের প্রান্তিকতায় এসে দাঁড়িয়েছে। নৃতাত্ত্বিক ও ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে, অবিভক্ত ভারতবর্ষে আর্যদের আগমনের বহু পূর্বেই আদিবাসীরা ভারতে এসেছিলেন, কিন্তু আর্যরা ভারতবর্ষে পরে এলেও তাদেরকে ভারতবর্ষের প্রতিষ্ঠাতা ধরা হয় (ঘোষ, ২০০০:১১)। পরবর্তী সময়ে আর্যরা ভারতবর্ষে এসে বসতি স্থাপন করে এবং আদিবাসীদেরকে তাদের নিজেদের বাসস্থান থেকে বিতাড়িত করে বসতি বিস্তার করতে শুরু করে (বাস্কে, ১৯৯৯)। আর্যদের ভূমিদখল প্রক্রিয়ার একটি পর্যায়ে আদিবাসীরা পঞ্চসিন্ধু, যমুনা, গঙ্গা ও নর্মদা, কাবেরী উপত্যকা আর্য অভিযাত্রীর কাছে ছেড়ে দিয়ে দূর্গম গিরিকন্দরে ও অরণ্যে আশ্রয় গ্রহণ করে (ঘোষ, ২০০০:১১)। কিন্তু হাজার বছর ধরে আর্য-ভারত এবং আদি-ভারতে একই ভৌগলিক সীমারেখার মধ্যে থেকেও আদিবাসী সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটেনি (প্রাগুক্ত, পৃ-৯)। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় অবিভক্ত ভারতবর্ষ বিভাগের পরবর্তী সময়ে তিনটি আলাদা রাষ্ট্রে (ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান) বসবাসরত আদিবাসীরা মোট জনগোষ্ঠীর ক্ষুদ্র অংশ হিসেবে নিজ নিজ রাষ্ট্রে নাগরিক মৌলিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে এখনো আন্দোলন করছে।
ভারতবর্ষে আদিবাসী বিষয়ক নৃতাত্ত্বিক গবেষণা শুরু হওয়ার প্রথম পর্যায়ে এই জনগোষ্ঠীকে ‘ট্রাইব’ বলা হ’ত। উনবিংশ শতকের ইংরেজ নৃবিজ্ঞানীগণ নৃতাত্ত্বিক সমীক্ষা চালানো সময় অনুন্নত ও জ্ঞাতিসম্পর্কীয় জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করতে রোমান শব্দ ‘ট্রাইবুয়া’ (ট্রাইবুয়া> ট্রাইবাস্>ট্রাইব) থেকে ‘ট্রাইব’ শব্দটি ব্যবহার করা শুরু করেন (বিশ্বাস, ২০০৫:৬)। তৎকালীন ভারতীয় সরকারি নথি-পত্রে এবং নৃবৈজ্ঞানিক গবেষণাসমূহে এই জনগোষ্ঠীগুলোকে ট্রাইব, সেমিহিন্দুইজড এ্যাবোরিজিন (ঞৎরনব ্ ঝবসর- ঐরহফঁরুবফ ধনড়ৎরমরহব) হিসেবে চিহ্নিত করা হয় (প্রাগুক্ত, পৃ-৬)।

দীপঙ্কর ঘোষ সম্পাদিত ‘বাংলা সাময়িকপত্রে আদিবাসীকথা (২০০৫)’ গ্রন্থের সম্পাদকীয়তে উল্লেখ আছে যে, ভারতে ১৮৯১ সালের আদমশুমারীতে আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে ‘জঙ্গলের আদিবাসী’ বা বনবাসী (ঋড়ৎবংঃ ঞৎরনব) হিসেবে বলা হয়। ১৯০১ সালের লোকগণনায় অহরসরংঃ, ১৯১১ সালের প্রদত্ত তথ্যে ঞৎরনধষ ধহরসরংঃ ড়ৎ ঢ়বড়ঢ়ষব ভড়ষষড়রিহম ঃৎরনধষ ৎবষরমরড়হ হিসেবে পরিচিতি পায়, ১৯২১ সালের লোকগণনায় এই জনগোষ্ঠীকে পাহাড়ি ও জঙ্গলের অধিবাসী ও ১৯৩১ সালের লোকগণনায় ‘আদিম জনজাতি’ (ঢ়ৎরসরঃরাব ঃৎরনব) হিসাবে বর্ণনা করা হয়। এছাড়া ১৯৩৫ সালে ভারত সরকারের এ্যাক্ট অনুসারে এই জনগোষ্ঠীকে ‘পশ্চাৎপদ জনজাতি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। পরবর্তী পর্যায়ে এই গোষ্ঠীসমূহের মানুষকে অন্যান্য মানুষ থেকে আলাদা করে বোঝানোর জন্য নরগোষ্ঠী, নৃগোষ্ঠী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, পাহাড়ি, জংলী, জুম্মা, নিম্নবর্গের মানুষ প্রভৃতি সমার্থক সম্বোধনসূচক শব্দ বা নাম ব্যবহার করা হয়েছে।

ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশরা ধনড়ৎরমরহব ও ধনড়ৎরমরহধষ ঃৎরনবং শব্দগুলো ব্যবহার করেছে অর্থনৈতিকভাবে দূর্বল ও শিক্ষাক্ষেত্রে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক ও শিক্ষার দিক থেকে অগ্রসর জনগোষ্ঠী থেকে আলাদা করে উপস্থাপনের জন্য (বিশ্বাস, ২০০৫:৪)। বাংলাদেশের সরকারি নথিপত্রে এই জনগোষ্ঠীকে ‘উপজাতি’ হিসেবে সম্বোধন করা হয়েছে (প্রাগুক্ত, পৃ-৬)। সরকারি পর্যায়ে ‘উপজাতি’ শব্দটি গ্রহণযোগ্য হলেও দেশের নাগরিক সমাজে ব্যাপক সমালোচনার সন্মুখীন হয়েছে। ‘উপজাতি’ (অবজ্ঞা অর্থে ব্যবহৃত) নাম পরিবর্তনের জন্য শুধুমাত্র নাগরিক সমাজ নয় সমতল ও পাহাড়ি জনপদের আদবাসীরাও বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন মাধ্যমে আবেদন জানিয়েছে। কিন্তু প্রত্যেকটি সরকার তাদের র্র্পূবাবস্থানে অটুট রয়েছে। বর্তমানে বেসরকারি পর্যায়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই জনগোষ্ঠীকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে সম্বোধন করা হচ্ছে। কিন্তু বুদ্ধিজীবী মহলে ‘আদিবাসী’ শব্দ নিয়েও নানা ধরনের তাত্ত্বিক বিতর্ক রয়েছে। মূলত ইংরেজি ওহফরমবহড়ঁং শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে বর্তমানে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে ‘উপজাতি’ শব্দের একটি গ্রহণযোগ্য বিকল্প হিসেবে এটি গণ্য করা যায় না। আন্তর্জাতিকভাবে ওহফরমবহড়ঁং চবড়ঢ়ষবং বলতে তাদেরকে বোঝানো হচ্ছে, যাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চলছে (সংহতি, ২০০৩:২৭)।

সময় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিদ্যাজগতে উল্লেখিত নামগুলো পরিবর্তিত হয়েছে, যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন সম্বোধনসূচক শব্দ। পরিবর্তীত সম্বোধনসূচক শব্দগুলো আদিবাসীদের নিজেদের দেয়া নয়। বরং উল্লেখিত শব্দসমূহ তৈরি হয়েছে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গবেষকবৃন্দের জ্ঞান ও চিন্তাচেতনা থেকে। ফলে গবেষকদের পরিবর্তনশীল জ্ঞানচর্চার ধারায় বিশ্বব্যাপী আদিবাসীদের সার্বজনীন জাতিগত পরিচয় নির্মাণের জন্য নির্দিষ্ট কোন সম্বোধনসূচক শব্দ আজ পর্যন্ত তৈরি হয়নি।
পৃথিবীতে বসবাসকারী সকল আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে সামগ্রিকভাবে বোঝানোর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ও ব্যক্তি পর্যায়ে নানা ধরনের সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, “ঞযব ড়িৎষফ ঈড়ঁহপরষ ড়ভ ওহফরমবহড়ঁং ঢ়বড়ঢ়ষব এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, ‘‘ওহফরমবহড়ঁং ঢ়বড়ঢ়ষবং ধৎব ংঁপয ঢ়ড়ঢ়ঁষধঃরড়হ মৎড়ঁঢ়ং ধং বি ধৎব, যিড় ভৎড়স ড়ষফ-ধমব ঃরসবং যধাব রহযধনরঃবফ ঃযব ষধহফং যিবৎব বি ষরাব, যিড় ধৎব ধধিৎব ড়ভ যধারহম ধ পযধৎধপঃবৎ ড়ভ ড়ঁৎ ড়হি রিঃয ংড়পরধষ ঃৎধফরঃরড়হং ধহফ সবধহং ড়ভ বীঢ়ৎবংংরড়হ ঃযধঃ ধৎব ষরহশবফ ঃড় ঃযব পড়ঁহঃৎু রহযবৎরঃবফ ভৎড়স ড়ঁৎ ধহপবংঃড়ৎং, রিঃয ধ ষধহমঁধমব ড়ভ ড়ঁৎ ড়হি ধহফ যধারহম পবৎঃধরহ বংংবহঃরধষ ধহফ ঁহরয়ঁব পযধৎধপঃবৎরংঃরপং যিরপয পড়হভবৎ ঁঢ়ড়হ ঁং ঃযব ংঃৎড়হম পড়হারপঃরড়হ ড়ভ নবষড়হমরহম ঃড় ধ ঢ়বড়ঢ়ষব, যিড় যধাব ধহ রফবহঃরঃু রহ ড়ঁৎংবষাবং ধহফ ংযড়ঁষফ নব ঃযঁং ৎবমধৎফবফ নু ড়ঃযবৎং (জধযধসধহ, ২০০৬:৫৫).’’ অর্থাৎ আদিবাসী জনগোষ্ঠী বলতে এমন সব জনগোষ্ঠীকে বোঝায়, যারা প্রাচীনকাল থেকে তাদের পূর্বপুরুষের কাছ থেকে পাওয়া ভূমিতে উত্তরাধিকার সূত্রে বসবাস করছে। যারা নিজেদের সামাজিক ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষায় রক্ষণশীল। যাদের নিজস্ব ভাষা ও অন্যান্য কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা তাদেরকে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী থেকে পৃথক হিসেবে চিহ্নিত করছে।

দীপঙ্কর ঘোষ, ‘বাংলা সাময়িকপত্রে আদিবাসীকথা (২০০৫)’ গ্রন্থের সম্পাদকীয়তে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মূল বৈশিষ্ট্য হিসেবে কয়েটি বিষয় তুলে ধরেন, সেগুলো হল-
(ক) আদিবাসীরা একটি নির্দিষ্ট ভৌগলিক অঞ্চলে বাস করে নিজস্ব জীবনধারণের ঐতিহ্য বহন করে
(খ) আদিবাসীরা ভাষা, আচার, ধর্মীয় বিশ্বাস, শিল্পকলার ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র
(গ) পেশাগত দিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রাচীন উপাদানের বিশেষত্ব দেখা যায়
(ঘ) সাধারণত আদিবাসীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ ও অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাদপদ হিসেবে দেখা হয়
Working Group on Indigenous Populations (WGIP)–র ১৯৮৫ সাল থেকে তাদের প্রণীত আদিবাসী অধিকার বিষয়ক খসড়া ঘোষণাপত্র United Nations Declaration on the Rights of Indigenous Peoples-এ আদিবাসীদের মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার কথা বিস্তৃতভাবে স্বীকার করা হয় এবং নিম্নোক্ত বিষয়সমূহ সন্নিবেশ করা হয়-

ক্স আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার
ক্স সমষ্টিগত মালিকানার অধিকার
ক্স ভূমি, ভূখন্ড ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণের অধিকার
এখানে আদিবাসীদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ (ইন্টেলেকচুয়্যাল প্রপার্টি) সংরক্ষণের মাধ্যমে তাদের রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ বজায় রাখা এবং আদিবাসী জনগণের উপর, তাদের সম্পত্তি ও ভূখন্ডের উপর প্রভাব ফেলে এমন যে কোন কাজের ক্ষেত্রে আদিবাসীদের পূর্ব সম্মতি নেয়া ও তাদের কার্যকরী অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণের দিকে বিশেষভাবে জোর দেয়া হয়েছে (সংহতি, ২০০৩:৪০-৪১)।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আইনগুলোতে আদিবাসীদের সমষ্টিগত/সমন্বিত অধিকারকে শ্রদ্ধার চোখে দেখার কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বহুপাক্ষিক সংস্থা বা সংগঠন সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে এ বিষয়ে নিয়ে আরও বিস্তর আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। জাতিসংঘ ১৯৮৯ সালে আদিবাসীদের অধিকারের ওপর একটি সার্বজনীন ঘোষণাপত্র জারি করেছে। এ ঘোষণাপত্রে স্পষ্টভাবে আদিবাসীদের অধিকারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশে ২০০৫ সালে সরকার কর্তৃক প্রণীত ‘‘প্রথম জাতীয় দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র (চজঝচ-১)’’ প্রণয়ন করা হয়; যেখানে আদিবাসীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ ও অধিকার লংঘনের কথা উল্লেখ করা হয়। দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্রে আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে বাংলা ভাষায় ‘‘আদিবাসী’’ এবং ইংরেজিতে ‘ÔÔEthnic MinorityÕÕ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়কে আদিবাসী ও ওহফরমবহড়ঁং শব্দ ব্যবহার না করে উপজাতি ও ঞৎরনধষ শব্দ ব্যবহার করতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের বিভিন্ন আইন যেমন, ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন, ১৯৫০ সালের ভূমি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ও ১৯৯৫ সালের অর্থ আইনে ওহফরমবহড়ঁং ও ধনড়ৎরমরহধষ শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়েছে (প্রাগুক্ত, পৃ-২৩)।

পৃথিবীতে কোন একটি দেশে শুধুমাত্র একটি জাতিগোষ্ঠী বসবাস করে-এই ধরনের বৈশিষ্ট্য মন্ডিত রাষ্ট্রের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বাংলাদেশে বাঙালিদের পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর আদিবাসীরা বসবাস করছে। কিন্তু বাংলাদেশে আদিবাসী লোকসংখ্যা কত এবং কতগুলো স্বতন্ত্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ এখানে বসবাস করছে সেই বিষয়ে সরকারি নথিপত্রে উল্লেখিত পরিসংখ্যান বর্তমানে আদিবাসীদের কাছে বিতর্কিত।

বাংলাদেশের ‘‘রাষ্ট্রীয় ভূমি অধিগ্রহণ এবং প্রজাসত্ত্ব আইন (১৯৫০)’’ এর ৯৭ নং অনুচ্ছেদে বাংলাদেশে বসবাসরত অনেক স্বতন্ত্র আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর নাম উল্লেখ নেই। রাষ্ট্রীয় ভূমি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ (ইস্ট বেঙ্গল এ্যাক্ট নং ২৮/১৯৫১) ৯৭ ধারার ১ নং উপধারা অনুযায়ী কোন জেলায় স্থানীয় এলাকার নিন্মলিখিত সমাজ বা গোত্র উপজাতি বা আদিবাসী বলে গণ্য হবে, যথা- ১.সাঁওতাল; ২. বানিয়াস; ৩. ভূঁইয়া; ৪. ভূমিজ; ৫. দালুস; ৬. গারো; ৭. গণ্ডা; ৮. হদী; ৯. হাজং; ১০. হো; ১১. খরিয়; ১২. খারওয়ার; ১৩. কোরা; ১৪. কোচ; ১৫. মগ; ১৬. মাল এবং সুরিয়া ১৭.পাহাড়িয়া; ১৮. মাচজ; ১৯. মুণ্ডা; ২০. মুণ্ডাই; ২১. ওড়াং এবং ২২. তোড়ি (খান, ১৯৯৯: ৮৬-৮৭ ও ছিদ্দিক, ২০০২: ৫৬-৫৮)। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম কর্তৃক লিখিত ও সম্পাদিত বিভিন্ন প্রকাশনায় বাংলাদেশে ৪৫টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করে এমন তথ্য পাওয়া যায় (সংহতি, ২০০৭:১৩৫)। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের প্রকাশনা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসী জনগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র নামভিত্তিক পরিচয় নিম্নরূপ-
আসাম (অহমিয়া), ওঁরাও, কোচ, কোল, কর্মকার, ক্ষত্রীয় বর্মণ, খাসি, খারিয়া, খিয়াং, খুমি, খন্ড, গারো, গুরখা, গন্ড, চাকমা, চাক, তুরী, তঞ্চঙ্গ্যা, ত্রিপুরা, ডালু, পাংখো, পাহাড়িয়া, পাহান, পাত্র, বম, বানাই, বিদিয়া, বাগদি, মারমা, ম্রো, মণিপুরি, মাহাতো, মুন্ডা, মালো, মাহালী, মুরিয়ার, মুসহর, রাখাইন, রাই, রাজবংশী, রাজোয়াড়, লুসাই, সাঁওতাল, সিং, হাজং।
বাংলাদেশে আদিবাসীদের মোট লোকসংখ্যা কত সে বিষয়েও বিতর্ক রয়েছে। ১৯৯১ সালের সরকারি লোকগণনায় বাংলাদেশে ২৯টি আদিবাসী সম্প্রদায়ের মোট আদিবাসী ১২,০৫,৯৭৮ জন মানুষ বসবাস করছে বলে উল্লেখ করা হয় এবং উল্লেখিত সরকারি আদমশুমারিতে অনেক জাতিগোষ্ঠীর নাম উল্লেখ নেই এবং কিছু কিছু জাতির নাম দু’বারও লেখা হয়েছে (দ্রং ও ত্রিপুরা, ২০০৪:৭)। পরবর্তী ২০০১ সালের লোকগণনায় আদিবাসী জনসংখ্যা জানার জন্য কোন কলাম রাখা হয়নি (আদিবাসী মানবাধিকার রির্পোট ২০০৮:১০)। কিন্তু বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের দাবি অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৩০ লাখ আদিবাসী বাস করে, যা মোট জনসংখ্যার ২% (আদিবাসী মানবাধিকার রির্পোট ২০০৮:১১)।

প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে, যা ওই সমাজ ব্যবস্থা ও পরিবেশের সাথে ওতোপ্রতভাবে জড়িত। আদিবাসী বিষয়ে বৈশ্বিক আলোচনায় বর্তমানে যে বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে তা হলো, কিছু কিছু নৃগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী জীবন দর্শনে পরির্বতন আসছে। পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় আদিবাসীদের অনেক সাংস্কৃতিক উপাদান চিরতরে হারিয়ে গেছে, কিছু হারানোর পথ অতিক্রমের অপেক্ষায়। একটি পূর্ণাঙ্গ সংস্কৃতি হচ্ছে একটি সম্পূর্ণ জীবনব্যবস্থা। কোন স্থানে বিরাজমান সংস্কৃতি ওই স্থানের জনগণের বৈশিষ্ট্যকে বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করে। সেই সূত্র ধরে আদিবাসী জীবন-সংস্কৃতির উপরোক্ত বর্ণিত ধারা দীর্ঘস্থায়ী হলে বাংলাদেশের অধিকাংশ ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ তাদের নিজস্ব জীবনধারার কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক উপাদান চিরতরে হারিয়ে ফেলবে। বৈশ্বিক সাংস্কৃতিক বলয়ের প্রভাবে তাদের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক উপাদান হারিয়ে যেতে পারে, অথবা তা ভিন্ন ধারায় উপস্থাপিত হতে পারে।
দীর্ঘদিন ধরে একই ভৌগলিক অবস্থানে পাশাপাশি বসবাস করলেও আদিবাসীদের জীবন-সংস্কৃতি সম্পর্কে বৃহত্তর বাঙালি সমাজের ধারণা আজও অপরিচিত ও অস্পষ্ট এবং কোন কোন ক্ষেত্রে ভ্রান্ত। বাংলাদেশে বসবাসকারী স্বতন্ত্র জাতিসত্ত্বা হিসেবে ডালু আদিবাসীদের সামগ্রিক জীবনসংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে খুব সীমিত সংখ্যক গবেষণা হয়েছে। ইতিমধ্যে ডালুদের সম্পর্কে যে সব গবেষণা হয়েছে সেখানে ডালুদের পূর্ণাঙ্গ সমাজ ও সংস্কৃতির পরিচয় তুলে না ধরলেও ডালুদের সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আংশিক ধারণা পেতে সহায়তা করে। ডালুদের বর্তমান জীবনযাত্রার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ লিপিবদ্ধ করার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বর্তমান গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে একটি স্বতন্ত্র জাতিসত্তা হিসেবে ডালুদের সামগ্রিক জীবন ধারা ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে গবেষণা তথ্য সহায়ক হতে পারে।


লিখেছেন ঃ *মোঃ এরশাদ আলী , গবেষণা কর্মকর্তা হিসেবে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজ ( বারসিক)-এ কর্মরত।

sfd

sfd

আমাদের কথা

বেশি পড়া হয়েছে

যুক্ত হউন

সাম্প্রতিক

আপনি একজন ............

জানতে চাই আপনার কথা

Name

Email *

Message *