চীনের উদ্যোগে নেয়া প্রতিষ্ঠানটির নাম হবে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক বা এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি); যা চলতি বছরের শেষ দিকে ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের তহবিল নিয়ে যাত্রা শুরু করবে।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীনের এই উদ্যোগের সঙ্গে বাংলাদেশও সম্পৃক্ত থাকবে। এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত এশিয়ার ২২টি দেশ আগ্রহ দেখিয়েছে। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি সম্পদশালী দেশও রয়েছে। অন্যদিকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ৬ জাতি সংস্থা সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে জোটের পঞ্চম শীর্ষ সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে ব্রিক্স উন্নয়ন ব্যাংক গঠনের বিষয়ে একমত হয়েছেন সদস্য দেশগুলোর নেতারা। এই বৈঠকে ঘোষণা দিয়েছে ব্রিক্স গঠনের। ব্রিক্স জোটে রয়েছে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার মত উদীয়মান শক্তির অর্থনীতির দেশগুলো।
এআইআইবি গঠনের প্রক্রিয়ায় সরাসরি জড়িতদের একজন বলেন, চীন মনে করে, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ যা-ই করে, তাতে তারা তেমন গুরুত্ব পায় না। সে জন্য দেশটির নেতারা নিজস্ব ‘বিশ্বব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এতে তাদের হাতেই থাকে প্রস্তাবিত প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃত্ব।
এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ও ইউরোপের সঙ্গে স্থলপথের সংযোগ স্থাপন এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে অর্থায়ন করাই হবে প্রস্তাবিত এই ব্যাংকের প্রধান লক্ষ্য।
ব্যাংকটিতে সিংহভাগ তহবিলের জোগান দেবে এর মূল উদ্যোক্তা চীন। প্রতিষ্ঠানটি প্রাচীনকালে প্রাথমিকভাবে ইউরোপ ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যিক সংযোগ স্থাপনকারী ‘সিল্ক রোড’-এর মতো নতুন আরেকটি মহাসড়ক নির্মাণের ওপর জোর দেবে। পাশাপাশি চীনের রাজধানী বেইজিং থেকে উপসাগরীয় দেশ ইরাকের রাজধানী বাগদাদ পর্যন্ত সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপনসহ এই অঞ্চলে নানা অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থের জোগান দেবে প্রতিষ্ঠানটি। এআইআইবি সরাসরি এডিবির জন্য চ্যালেঞ্জ হবে দাঁড়াবে বলে মনে করা হচ্ছে। চীনা পরিকল্পনা সফল হলে এআইআইবির তহবিলের পরিমাণ হবে এডিবির ১৬ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের তহবিলের দুই-তৃতীয়াংশের সমান।
৬৭টি সদস্যদেশের সংস্থা এডিবির সবচেয়ে বড় দুই শেয়ারহোল্ডার হলো জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র। তাদের শেয়ার হলো যথাক্রমে ১৫ দশমিক ৭ ও ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ। ১৯৬৬ সালে এডিবির প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় থেকেই এর প্রেসিডেন্ট পদটি রয়েছে জাপানের দখলে। আর চীনের শেয়ার মাত্র সাড়ে ৫ শতাংশ। প্রক্রিয়াটির সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা জানান, চীন তার পরিকল্পনাটি নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া এবং এমনকি ‘শত্র“ প্রতিবেশী’ জাপানের সঙ্গেও আলোচনা করেছে। এশিয়ার অনেক দেশই এতে যোগ দিতে আগ্রহ দেখিয়েছে। তবে কেউ এগিয়ে না এলেও চীন একাই সামনের দিকে যাবে।তবে তারা যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের নেবে না ইতিমধ্যে চীন ১০টি দেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকও সই করেছে। এ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দেশটি ইতিমধ্যে এডিবির সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও চায়না সার্বভৌম সম্পদ তহবিলের সাবেক চেয়ারম্যান জিন লিকুনকে নিয়োগ দিয়েছে। তিনি ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছেন। এডিবির প্রধান তাকেহিকো নাকাও গত মাসের শেষ দিকে সতর্কতার সঙ্গে চীনের এআইআইবি গঠনের প্রস্তাবকে স্বাগত জানান। তবে নতুন ব্যাংকটি শ্রম, পরিবেশসহ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থাগুলোকে অবজ্ঞা করে চলতে পারবে না বলেও সতর্ক করে দেন।
কারণ এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় বিনিয়োগ করতে গিয়ে চীনারা সুশাসনের তোয়াক্কা করে না এবং বিবেকহীনতার পরিচয় দিয়ে থাকে বলে প্রায়শই অভিযোগ ওঠে।
এডিবির পূর্বাভাস অনুযায়ী এশিয়ার অবকাঠামো খাতে এখন থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছরে ৮০ হাজার কোটি ডলার করে বিনিয়োগ প্রয়োজন। অথচ সংস্থাটি বছরে মাত্র এক হাজার কোটি ডলার ঋণ দিয়ে থাকে। এ থেকেই অনুমেয় যে এআইআইবির মতো আরও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সুযোগ রয়েছে।
চীনভিত্তিক বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া (বিএফএ), দ্য ডংচেং ডিস্ট্রিক্ট গভর্নমেন্ট অব বেইজিং, চায়না ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক এক্সচেঞ্জেস ও গ্লোবাল ফাউন্ডেশন অব অস্ট্রেলিয়া যৌথভাবে একটি সেমিনারের আয়োজন করেছে। এতে বাংলাদেশসহ এশিয়ার ৪৮টি দেশ যোগ দিয়েছে।
বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়ার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, সাবেক তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন জানান, এআইআইবি গঠনের প্রস্তাব আসে সর্বশেষ বালিতে অনুষ্ঠিত বোয়াও ফোরামের সম্মেলনে। সেখানেই এআইআইবি গঠনের লক্ষ্যে গঠিত হয় ওয়ার্কিং গ্র“প।
এদিকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ব্রিক্স ব্যাংক গঠনের ফলে আগামী ২০১৭ সাল নাগাদ খবরদারির ক্ষমতা কমে যাবে বিশ্ব ব্যাংকের। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) আদলে গঠিত হয়েছে নতুন ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ব্রিক্স। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অর্থনৈতিক অবকাঠামো উন্নয়নে সব ধরনের আর্থিক সহায়তা দেবে এই আর্থিক সংস্থাটি। জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর টাকায় পরিচালিত মার্কিন নীতির ধারক বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অতিরিক্ত খবরদারি করে বলে অভিযোগ রয়েছে। ব্যাংক সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছেন, আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে সবসময়েই মার্কিন আর্থিক নীতি অনুসরণ করে। যে কারণে ঋণ গ্রহীতা দেশগুলোর অর্থনীতি থাকে টালমাটাল অবস্থায়। এই অচলায়াতন ভাঙতেই ভারত, ব্রাজিল, চীন, রাশিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকা যৌথমালিকানায় গঠন করেছে ব্রিক্স ডেভেলমপেন্ট ব্যাংক।
এই অচলায়তনকে কাটিয়ে তুলতে ২০১৭ সালের মধ্যেই প্রাথমিকভাবে ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার মূলধন নিয়ে যাত্রা শুরু করবে নতুন আর্থিক সংস্থাটি। পাঁচটি দেশেরই থাকবে সমান শেয়ার মূলধন। প্রথম ছয় বছর ব্রিক্স প্রধানের দায়িত্বে থাকবে ভারত। চীনের সাংহাই শহরে থাকবে ব্রিক্সের সদর দফতর।
প্রধান তিন উদ্যোক্তা দেশ ভারত, চীন এবং রাশিয়া বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু হওয়ায় ব্রিক্স থেকে সবচেয়ে বেশি আর্থিক সহায়তা পাবে বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছেন, বিশ্বব্যাংকের ঝণ সহায়তা গ্রহনের ক্ষেত্রে যে সব শর্ত থাকে তা কখনোই উন্নয়শীল দেশগুলোর জন্য সহায়ক নয়। যার ফলে আফ্রিকা এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো অর্থনৈতিক ভাবে এখনো আলোর মুখ দেখতে পায়নি। বিশ্বব্যাংকের অতিরিক্ত খবরদারির কারণে শ্রীলঙ্কা এবং মালয়েশিয়া এই সংস্থাটিকে বয়কট করে চলছে দীর্ঘদিন ধরে। ভারত কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর সহায়তা নিলেও কোনোরকম খবরদারি করতে দেয়না। আফ্রিকার অনেক দেশ বিশেষত হাইতি, ঘানা, এবং সোমালিয়া শর্তযুক্ত বিশ্বব্যাংকের ঋণ নিয়ে তাদের আর্থিক অবস্থা চরম বিপর্যয়ের মুখে ফেলেছে।
বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকেও ঋণ সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সময় কঠোর শর্ত জুড়ে দেয় যা আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে অনেকটাই শ্লথ করে দেয় বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। এবিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবীদ ও জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবুল বারাকাত বলেন, বিশ্বব্যাংক জাতিসংঘের সদস্যদের টাকায় পরিচালিত হলেও ঋণ সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে মার্কিন আগ্রাসী নীতি অনুসরণ করে যার ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলো সুবিধা করে উঠতে পারেনা। উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিনিধিত্ব করার জন্য গড়ে ওঠা নতুন একটি আর্থিক সংগঠন। ব্রিক্স যদি বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক মনোভাব নিয়ে বাজারে আসে সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের ওপর থেকে চাপ কমে যাবে। তিনি আরো বলেন যেহেত বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু দেশ প্রথমে এটার দায়িত্বে রয়েছে, যার ফলে সবচেয়ে বেশি সুবিধা আমাদের পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে ব্রিক্স চালু হলে বাংলাদেশের উপর বিশ্বব্যাংকের খবরদারি বন্ধ হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে, ব্রিক্সের সদর দফতর চীনের সাংহাইয়ে হলেও প্রথম ছয় বছরের জন্য সভাপতির দায়িত্ব পাচ্ছে ভারত। দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় সভাপতি হবে যথাক্রমে ব্রাজিল ও রাশিয়া। তবে তাদের মেয়াদ হবে পাঁচ বছর করে। বোর্ড অব গভর্নস-এর প্রথম প্রধান হবে রাশিয়া। ১০ হাজার কোটি ডলার শেয়ার মূলধনের মধ্যে আপাতত পাঁচটি দেশ সমান মালিকানার ভিত্তিতে হাতে নিচ্ছে মোট পাঁচ হাজার কোটি ডলারের শেয়ার প্রতিটি দেশের হাতে থাকছে এক হাজার কোটি ডলারের শেয়ার মূলধন। পরে ব্যাংকের সম্প্রসারণ হলে বাকি মূলধনও হাতে নিতে পারবে সদস্য দেশগুলো। ব্রিক্সের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, মালিকানায় থাকা পাঁচটি দেশের অর্থনৈতিক ভীত শক্তিশালী করা। কোনো রকম আর্থিক ঝুঁকিতে পড়লে এই ব্যাংক থেকে নিজেরা সহায়তা নেবে। একই সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অবকাঠামো উন্নয়নে সব রকম আর্থিক সহায়তা দেবে ব্রিক্স।
বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ মার্কিন তদারকিতে চলায় অনেক দেশই এই দুটি সংস্থা থেকে প্রয়োজনের সময় তেমন কোনো আর্থিক সহায়তা পায় না। কোনো কোনো দেশের আর্থিক দুর্বলতার সুযোগে সংস্থা দুটি শর্তের বেড়াজালে মার্কিন আর্থিক নীতি প্রয়োগ করে যা অনেক উন্নত রাষ্ট্রের পছন্দ নয়। যে কারণেই জš§ হলো ব্রিক্স। ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের এমন ধারণা দেশীয় অর্থনীতিবিদদের। ব্রিক্স নামক নতুন এই আর্থিক সংস্থাটি উন্নয়নশীল বিশ্বে মার্কিন চাপ কমিয়ে নতুন অর্থনৈতিক ধারার সূচনা করবে এমন আশা তাদের।
উৎসঃ আমাদেরমানচিত্র
0 comments:
Post a Comment