বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বহুসংখ্যক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিন যাবত বসবাস করে আসছে। বাঙালিদের সাথে একই ভৌগলিক সীমারেখার মধ্যে বসবাস করলেও এই সব জনগোষ্ঠীর প্রত্যেকেরই রয়েছে আলাদা আলাদা ভাষা, ঐতিহ্য, সাহিত্য, লোকগাথা, সাংস্কৃতিক চর্চা ও স্থানীয় জ্ঞান। আদিবাসীদের নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চার মধ্য দিয়ে এদেশের সংস্কৃতি বহুমাত্রিকতা লাভ করেছে। কিন্তু বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বহুমাত্রিক ক্ষমতা চর্চার নেতিবাচক প্রভাবে আদিবাসীদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি আজ বিপন্ন প্রায়। কিন্তু ‘আদিবাসী অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র’- শীর্ষক সনদের ৩নং ধারায় বলা হয়েছে, আদিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার রয়েছে এবং এই অধিকার বলে আদিবাসীরা স্বাধীনভাবে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান ও মর্যাদা নির্ণয় এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়নে কাজ করতে পারে (সংহতি, ২০০৭: ৮৯-৯০)। তথাপি বাংলাদেশে বাঁধ, সংরক্ষিত এলাকা, পার্ক, প্রতিবেশ-পর্যটন, সামাজিক বনায়ন, জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের মাধ্যমে আদিবাসীরা উন্নয়নের নামে উচ্ছেদ, প্রতারণা, ক্ষতির সন্মুখীন হচ্ছে এবং বনের আদিবাসীদের এখনো বলা হচ্ছে পরিবেশ উদ্বাস্তু (প্রাগুক্ত, পৃ-৮৯-৯০)। অন্যদিকে জাতিসংঘ মনে করে আদিবাসীদের জীবন-সংস্কৃতি ছিল পরিবেশের জন্য ভারসাম্য ও বন্ধুত্বপূর্ণ (প্রাগুক্ত, পৃ-৮৭)। প্রজন্মান্তরে আদিবাসী জনগণ বিশ্ব পরিবেশকে সমৃদ্ধ করছে।

বিশ্বের ৫টি মহাদেশের প্রায় ৭০টি দেশে কমপক্ষে ৫০০০ স্বতন্ত্র আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর প্রায় ৩৭ কোটি আদিবাসী বসবাস করছে (সংহতি, ২০০৩:৩৮ ও আদিবাসী মানবাধিকার রির্পোট, ২০০৮:১০)। পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসীদের মত দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশগুলোতে বসবাসকারী বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নিজেদের অস্তিত্ব ও স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ক্ষেত্রবিশেষে আজ বিলোপসাধনের প্রান্তিকতায় এসে দাঁড়িয়েছে। নৃতাত্ত্বিক ও ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে, অবিভক্ত ভারতবর্ষে আর্যদের আগমনের বহু পূর্বেই আদিবাসীরা ভারতে এসেছিলেন, কিন্তু আর্যরা ভারতবর্ষে পরে এলেও তাদেরকে ভারতবর্ষের প্রতিষ্ঠাতা ধরা হয় (ঘোষ, ২০০০:১১)। পরবর্তী সময়ে আর্যরা ভারতবর্ষে এসে বসতি স্থাপন করে এবং আদিবাসীদেরকে তাদের নিজেদের বাসস্থান থেকে বিতাড়িত করে বসতি বিস্তার করতে শুরু করে (বাস্কে, ১৯৯৯)। আর্যদের ভূমিদখল প্রক্রিয়ার একটি পর্যায়ে আদিবাসীরা পঞ্চসিন্ধু, যমুনা, গঙ্গা ও নর্মদা, কাবেরী উপত্যকা আর্য অভিযাত্রীর কাছে ছেড়ে দিয়ে দূর্গম গিরিকন্দরে ও অরণ্যে আশ্রয় গ্রহণ করে (ঘোষ, ২০০০:১১)। কিন্তু হাজার বছর ধরে আর্য-ভারত এবং আদি-ভারতে একই ভৌগলিক সীমারেখার মধ্যে থেকেও আদিবাসী সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটেনি (প্রাগুক্ত, পৃ-৯)। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় অবিভক্ত ভারতবর্ষ বিভাগের পরবর্তী সময়ে তিনটি আলাদা রাষ্ট্রে (ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান) বসবাসরত আদিবাসীরা মোট জনগোষ্ঠীর ক্ষুদ্র অংশ হিসেবে নিজ নিজ রাষ্ট্রে নাগরিক মৌলিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে এখনো আন্দোলন করছে।
ভারতবর্ষে আদিবাসী বিষয়ক নৃতাত্ত্বিক গবেষণা শুরু হওয়ার প্রথম পর্যায়ে এই জনগোষ্ঠীকে ‘ট্রাইব’ বলা হ’ত। উনবিংশ শতকের ইংরেজ নৃবিজ্ঞানীগণ নৃতাত্ত্বিক সমীক্ষা চালানো সময় অনুন্নত ও জ্ঞাতিসম্পর্কীয় জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করতে রোমান শব্দ ‘ট্রাইবুয়া’ (ট্রাইবুয়া> ট্রাইবাস্>ট্রাইব) থেকে ‘ট্রাইব’ শব্দটি ব্যবহার করা শুরু করেন (বিশ্বাস, ২০০৫:৬)। তৎকালীন ভারতীয় সরকারি নথি-পত্রে এবং নৃবৈজ্ঞানিক গবেষণাসমূহে এই জনগোষ্ঠীগুলোকে ট্রাইব, সেমিহিন্দুইজড এ্যাবোরিজিন (ঞৎরনব ্ ঝবসর- ঐরহফঁরুবফ ধনড়ৎরমরহব) হিসেবে চিহ্নিত করা হয় (প্রাগুক্ত, পৃ-৬)।

দীপঙ্কর ঘোষ সম্পাদিত ‘বাংলা সাময়িকপত্রে আদিবাসীকথা (২০০৫)’ গ্রন্থের সম্পাদকীয়তে উল্লেখ আছে যে, ভারতে ১৮৯১ সালের আদমশুমারীতে আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে ‘জঙ্গলের আদিবাসী’ বা বনবাসী (ঋড়ৎবংঃ ঞৎরনব) হিসেবে বলা হয়। ১৯০১ সালের লোকগণনায় অহরসরংঃ, ১৯১১ সালের প্রদত্ত তথ্যে ঞৎরনধষ ধহরসরংঃ ড়ৎ ঢ়বড়ঢ়ষব ভড়ষষড়রিহম ঃৎরনধষ ৎবষরমরড়হ হিসেবে পরিচিতি পায়, ১৯২১ সালের লোকগণনায় এই জনগোষ্ঠীকে পাহাড়ি ও জঙ্গলের অধিবাসী ও ১৯৩১ সালের লোকগণনায় ‘আদিম জনজাতি’ (ঢ়ৎরসরঃরাব ঃৎরনব) হিসাবে বর্ণনা করা হয়। এছাড়া ১৯৩৫ সালে ভারত সরকারের এ্যাক্ট অনুসারে এই জনগোষ্ঠীকে ‘পশ্চাৎপদ জনজাতি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। পরবর্তী পর্যায়ে এই গোষ্ঠীসমূহের মানুষকে অন্যান্য মানুষ থেকে আলাদা করে বোঝানোর জন্য নরগোষ্ঠী, নৃগোষ্ঠী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, পাহাড়ি, জংলী, জুম্মা, নিম্নবর্গের মানুষ প্রভৃতি সমার্থক সম্বোধনসূচক শব্দ বা নাম ব্যবহার করা হয়েছে।

ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশরা ধনড়ৎরমরহব ও ধনড়ৎরমরহধষ ঃৎরনবং শব্দগুলো ব্যবহার করেছে অর্থনৈতিকভাবে দূর্বল ও শিক্ষাক্ষেত্রে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক ও শিক্ষার দিক থেকে অগ্রসর জনগোষ্ঠী থেকে আলাদা করে উপস্থাপনের জন্য (বিশ্বাস, ২০০৫:৪)। বাংলাদেশের সরকারি নথিপত্রে এই জনগোষ্ঠীকে ‘উপজাতি’ হিসেবে সম্বোধন করা হয়েছে (প্রাগুক্ত, পৃ-৬)। সরকারি পর্যায়ে ‘উপজাতি’ শব্দটি গ্রহণযোগ্য হলেও দেশের নাগরিক সমাজে ব্যাপক সমালোচনার সন্মুখীন হয়েছে। ‘উপজাতি’ (অবজ্ঞা অর্থে ব্যবহৃত) নাম পরিবর্তনের জন্য শুধুমাত্র নাগরিক সমাজ নয় সমতল ও পাহাড়ি জনপদের আদবাসীরাও বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন মাধ্যমে আবেদন জানিয়েছে। কিন্তু প্রত্যেকটি সরকার তাদের র্র্পূবাবস্থানে অটুট রয়েছে। বর্তমানে বেসরকারি পর্যায়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই জনগোষ্ঠীকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে সম্বোধন করা হচ্ছে। কিন্তু বুদ্ধিজীবী মহলে ‘আদিবাসী’ শব্দ নিয়েও নানা ধরনের তাত্ত্বিক বিতর্ক রয়েছে। মূলত ইংরেজি ওহফরমবহড়ঁং শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে বর্তমানে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে ‘উপজাতি’ শব্দের একটি গ্রহণযোগ্য বিকল্প হিসেবে এটি গণ্য করা যায় না। আন্তর্জাতিকভাবে ওহফরমবহড়ঁং চবড়ঢ়ষবং বলতে তাদেরকে বোঝানো হচ্ছে, যাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চলছে (সংহতি, ২০০৩:২৭)।

সময় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিদ্যাজগতে উল্লেখিত নামগুলো পরিবর্তিত হয়েছে, যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন সম্বোধনসূচক শব্দ। পরিবর্তীত সম্বোধনসূচক শব্দগুলো আদিবাসীদের নিজেদের দেয়া নয়। বরং উল্লেখিত শব্দসমূহ তৈরি হয়েছে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গবেষকবৃন্দের জ্ঞান ও চিন্তাচেতনা থেকে। ফলে গবেষকদের পরিবর্তনশীল জ্ঞানচর্চার ধারায় বিশ্বব্যাপী আদিবাসীদের সার্বজনীন জাতিগত পরিচয় নির্মাণের জন্য নির্দিষ্ট কোন সম্বোধনসূচক শব্দ আজ পর্যন্ত তৈরি হয়নি।
পৃথিবীতে বসবাসকারী সকল আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে সামগ্রিকভাবে বোঝানোর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ও ব্যক্তি পর্যায়ে নানা ধরনের সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, “ঞযব ড়িৎষফ ঈড়ঁহপরষ ড়ভ ওহফরমবহড়ঁং ঢ়বড়ঢ়ষব এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, ‘‘ওহফরমবহড়ঁং ঢ়বড়ঢ়ষবং ধৎব ংঁপয ঢ়ড়ঢ়ঁষধঃরড়হ মৎড়ঁঢ়ং ধং বি ধৎব, যিড় ভৎড়স ড়ষফ-ধমব ঃরসবং যধাব রহযধনরঃবফ ঃযব ষধহফং যিবৎব বি ষরাব, যিড় ধৎব ধধিৎব ড়ভ যধারহম ধ পযধৎধপঃবৎ ড়ভ ড়ঁৎ ড়হি রিঃয ংড়পরধষ ঃৎধফরঃরড়হং ধহফ সবধহং ড়ভ বীঢ়ৎবংংরড়হ ঃযধঃ ধৎব ষরহশবফ ঃড় ঃযব পড়ঁহঃৎু রহযবৎরঃবফ ভৎড়স ড়ঁৎ ধহপবংঃড়ৎং, রিঃয ধ ষধহমঁধমব ড়ভ ড়ঁৎ ড়হি ধহফ যধারহম পবৎঃধরহ বংংবহঃরধষ ধহফ ঁহরয়ঁব পযধৎধপঃবৎরংঃরপং যিরপয পড়হভবৎ ঁঢ়ড়হ ঁং ঃযব ংঃৎড়হম পড়হারপঃরড়হ ড়ভ নবষড়হমরহম ঃড় ধ ঢ়বড়ঢ়ষব, যিড় যধাব ধহ রফবহঃরঃু রহ ড়ঁৎংবষাবং ধহফ ংযড়ঁষফ নব ঃযঁং ৎবমধৎফবফ নু ড়ঃযবৎং (জধযধসধহ, ২০০৬:৫৫).’’ অর্থাৎ আদিবাসী জনগোষ্ঠী বলতে এমন সব জনগোষ্ঠীকে বোঝায়, যারা প্রাচীনকাল থেকে তাদের পূর্বপুরুষের কাছ থেকে পাওয়া ভূমিতে উত্তরাধিকার সূত্রে বসবাস করছে। যারা নিজেদের সামাজিক ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষায় রক্ষণশীল। যাদের নিজস্ব ভাষা ও অন্যান্য কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা তাদেরকে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী থেকে পৃথক হিসেবে চিহ্নিত করছে।

দীপঙ্কর ঘোষ, ‘বাংলা সাময়িকপত্রে আদিবাসীকথা (২০০৫)’ গ্রন্থের সম্পাদকীয়তে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মূল বৈশিষ্ট্য হিসেবে কয়েটি বিষয় তুলে ধরেন, সেগুলো হল-
(ক) আদিবাসীরা একটি নির্দিষ্ট ভৌগলিক অঞ্চলে বাস করে নিজস্ব জীবনধারণের ঐতিহ্য বহন করে
(খ) আদিবাসীরা ভাষা, আচার, ধর্মীয় বিশ্বাস, শিল্পকলার ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র
(গ) পেশাগত দিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রাচীন উপাদানের বিশেষত্ব দেখা যায়
(ঘ) সাধারণত আদিবাসীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ ও অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাদপদ হিসেবে দেখা হয়
Working Group on Indigenous Populations (WGIP)–র ১৯৮৫ সাল থেকে তাদের প্রণীত আদিবাসী অধিকার বিষয়ক খসড়া ঘোষণাপত্র United Nations Declaration on the Rights of Indigenous Peoples-এ আদিবাসীদের মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার কথা বিস্তৃতভাবে স্বীকার করা হয় এবং নিম্নোক্ত বিষয়সমূহ সন্নিবেশ করা হয়-

ক্স আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার
ক্স সমষ্টিগত মালিকানার অধিকার
ক্স ভূমি, ভূখন্ড ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণের অধিকার
এখানে আদিবাসীদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ (ইন্টেলেকচুয়্যাল প্রপার্টি) সংরক্ষণের মাধ্যমে তাদের রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ বজায় রাখা এবং আদিবাসী জনগণের উপর, তাদের সম্পত্তি ও ভূখন্ডের উপর প্রভাব ফেলে এমন যে কোন কাজের ক্ষেত্রে আদিবাসীদের পূর্ব সম্মতি নেয়া ও তাদের কার্যকরী অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণের দিকে বিশেষভাবে জোর দেয়া হয়েছে (সংহতি, ২০০৩:৪০-৪১)।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আইনগুলোতে আদিবাসীদের সমষ্টিগত/সমন্বিত অধিকারকে শ্রদ্ধার চোখে দেখার কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বহুপাক্ষিক সংস্থা বা সংগঠন সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে এ বিষয়ে নিয়ে আরও বিস্তর আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। জাতিসংঘ ১৯৮৯ সালে আদিবাসীদের অধিকারের ওপর একটি সার্বজনীন ঘোষণাপত্র জারি করেছে। এ ঘোষণাপত্রে স্পষ্টভাবে আদিবাসীদের অধিকারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশে ২০০৫ সালে সরকার কর্তৃক প্রণীত ‘‘প্রথম জাতীয় দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র (চজঝচ-১)’’ প্রণয়ন করা হয়; যেখানে আদিবাসীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ ও অধিকার লংঘনের কথা উল্লেখ করা হয়। দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্রে আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে বাংলা ভাষায় ‘‘আদিবাসী’’ এবং ইংরেজিতে ‘ÔÔEthnic MinorityÕÕ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়কে আদিবাসী ও ওহফরমবহড়ঁং শব্দ ব্যবহার না করে উপজাতি ও ঞৎরনধষ শব্দ ব্যবহার করতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের বিভিন্ন আইন যেমন, ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন, ১৯৫০ সালের ভূমি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ও ১৯৯৫ সালের অর্থ আইনে ওহফরমবহড়ঁং ও ধনড়ৎরমরহধষ শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়েছে (প্রাগুক্ত, পৃ-২৩)।

পৃথিবীতে কোন একটি দেশে শুধুমাত্র একটি জাতিগোষ্ঠী বসবাস করে-এই ধরনের বৈশিষ্ট্য মন্ডিত রাষ্ট্রের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বাংলাদেশে বাঙালিদের পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর আদিবাসীরা বসবাস করছে। কিন্তু বাংলাদেশে আদিবাসী লোকসংখ্যা কত এবং কতগুলো স্বতন্ত্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ এখানে বসবাস করছে সেই বিষয়ে সরকারি নথিপত্রে উল্লেখিত পরিসংখ্যান বর্তমানে আদিবাসীদের কাছে বিতর্কিত।

বাংলাদেশের ‘‘রাষ্ট্রীয় ভূমি অধিগ্রহণ এবং প্রজাসত্ত্ব আইন (১৯৫০)’’ এর ৯৭ নং অনুচ্ছেদে বাংলাদেশে বসবাসরত অনেক স্বতন্ত্র আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর নাম উল্লেখ নেই। রাষ্ট্রীয় ভূমি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ (ইস্ট বেঙ্গল এ্যাক্ট নং ২৮/১৯৫১) ৯৭ ধারার ১ নং উপধারা অনুযায়ী কোন জেলায় স্থানীয় এলাকার নিন্মলিখিত সমাজ বা গোত্র উপজাতি বা আদিবাসী বলে গণ্য হবে, যথা- ১.সাঁওতাল; ২. বানিয়াস; ৩. ভূঁইয়া; ৪. ভূমিজ; ৫. দালুস; ৬. গারো; ৭. গণ্ডা; ৮. হদী; ৯. হাজং; ১০. হো; ১১. খরিয়; ১২. খারওয়ার; ১৩. কোরা; ১৪. কোচ; ১৫. মগ; ১৬. মাল এবং সুরিয়া ১৭.পাহাড়িয়া; ১৮. মাচজ; ১৯. মুণ্ডা; ২০. মুণ্ডাই; ২১. ওড়াং এবং ২২. তোড়ি (খান, ১৯৯৯: ৮৬-৮৭ ও ছিদ্দিক, ২০০২: ৫৬-৫৮)। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম কর্তৃক লিখিত ও সম্পাদিত বিভিন্ন প্রকাশনায় বাংলাদেশে ৪৫টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করে এমন তথ্য পাওয়া যায় (সংহতি, ২০০৭:১৩৫)। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের প্রকাশনা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসী জনগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র নামভিত্তিক পরিচয় নিম্নরূপ-
আসাম (অহমিয়া), ওঁরাও, কোচ, কোল, কর্মকার, ক্ষত্রীয় বর্মণ, খাসি, খারিয়া, খিয়াং, খুমি, খন্ড, গারো, গুরখা, গন্ড, চাকমা, চাক, তুরী, তঞ্চঙ্গ্যা, ত্রিপুরা, ডালু, পাংখো, পাহাড়িয়া, পাহান, পাত্র, বম, বানাই, বিদিয়া, বাগদি, মারমা, ম্রো, মণিপুরি, মাহাতো, মুন্ডা, মালো, মাহালী, মুরিয়ার, মুসহর, রাখাইন, রাই, রাজবংশী, রাজোয়াড়, লুসাই, সাঁওতাল, সিং, হাজং।
বাংলাদেশে আদিবাসীদের মোট লোকসংখ্যা কত সে বিষয়েও বিতর্ক রয়েছে। ১৯৯১ সালের সরকারি লোকগণনায় বাংলাদেশে ২৯টি আদিবাসী সম্প্রদায়ের মোট আদিবাসী ১২,০৫,৯৭৮ জন মানুষ বসবাস করছে বলে উল্লেখ করা হয় এবং উল্লেখিত সরকারি আদমশুমারিতে অনেক জাতিগোষ্ঠীর নাম উল্লেখ নেই এবং কিছু কিছু জাতির নাম দু’বারও লেখা হয়েছে (দ্রং ও ত্রিপুরা, ২০০৪:৭)। পরবর্তী ২০০১ সালের লোকগণনায় আদিবাসী জনসংখ্যা জানার জন্য কোন কলাম রাখা হয়নি (আদিবাসী মানবাধিকার রির্পোট ২০০৮:১০)। কিন্তু বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের দাবি অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৩০ লাখ আদিবাসী বাস করে, যা মোট জনসংখ্যার ২% (আদিবাসী মানবাধিকার রির্পোট ২০০৮:১১)।

প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে, যা ওই সমাজ ব্যবস্থা ও পরিবেশের সাথে ওতোপ্রতভাবে জড়িত। আদিবাসী বিষয়ে বৈশ্বিক আলোচনায় বর্তমানে যে বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে তা হলো, কিছু কিছু নৃগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী জীবন দর্শনে পরির্বতন আসছে। পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় আদিবাসীদের অনেক সাংস্কৃতিক উপাদান চিরতরে হারিয়ে গেছে, কিছু হারানোর পথ অতিক্রমের অপেক্ষায়। একটি পূর্ণাঙ্গ সংস্কৃতি হচ্ছে একটি সম্পূর্ণ জীবনব্যবস্থা। কোন স্থানে বিরাজমান সংস্কৃতি ওই স্থানের জনগণের বৈশিষ্ট্যকে বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করে। সেই সূত্র ধরে আদিবাসী জীবন-সংস্কৃতির উপরোক্ত বর্ণিত ধারা দীর্ঘস্থায়ী হলে বাংলাদেশের অধিকাংশ ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ তাদের নিজস্ব জীবনধারার কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক উপাদান চিরতরে হারিয়ে ফেলবে। বৈশ্বিক সাংস্কৃতিক বলয়ের প্রভাবে তাদের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক উপাদান হারিয়ে যেতে পারে, অথবা তা ভিন্ন ধারায় উপস্থাপিত হতে পারে।
দীর্ঘদিন ধরে একই ভৌগলিক অবস্থানে পাশাপাশি বসবাস করলেও আদিবাসীদের জীবন-সংস্কৃতি সম্পর্কে বৃহত্তর বাঙালি সমাজের ধারণা আজও অপরিচিত ও অস্পষ্ট এবং কোন কোন ক্ষেত্রে ভ্রান্ত। বাংলাদেশে বসবাসকারী স্বতন্ত্র জাতিসত্ত্বা হিসেবে ডালু আদিবাসীদের সামগ্রিক জীবনসংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে খুব সীমিত সংখ্যক গবেষণা হয়েছে। ইতিমধ্যে ডালুদের সম্পর্কে যে সব গবেষণা হয়েছে সেখানে ডালুদের পূর্ণাঙ্গ সমাজ ও সংস্কৃতির পরিচয় তুলে না ধরলেও ডালুদের সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আংশিক ধারণা পেতে সহায়তা করে। ডালুদের বর্তমান জীবনযাত্রার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ লিপিবদ্ধ করার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বর্তমান গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে একটি স্বতন্ত্র জাতিসত্তা হিসেবে ডালুদের সামগ্রিক জীবন ধারা ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে গবেষণা তথ্য সহায়ক হতে পারে।


লিখেছেন ঃ *মোঃ এরশাদ আলী , গবেষণা কর্মকর্তা হিসেবে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজ ( বারসিক)-এ কর্মরত।

0 comments:

Post a Comment

sfd

sfd

আমাদের কথা

বেশি পড়া হয়েছে

যুক্ত হউন

সাম্প্রতিক

আপনি একজন ............

জানতে চাই আপনার কথা

Name

Email *

Message *