বিতর্ক হল বিশেষভাবে তর্ক। অতি সাধারণ কথায় একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে দলীয় অবস্থান থেকে তত্ত্ব উদাহরণ ও তথ্য দিয়ে যুক্তিপূর্ণভাবে নিজের বক্তব্য উপস্থাপনাই হল বিতর্ক। বিতর্ককে বলা হয় উদ্বুদ্ধকরণ শিল্প। প্রাচীনকালে গ্রীসের এই চর্চাটি উপমহাদেশ হয়ে বাংলাদেশে আসে। বাংলাদেশে ডেইলী স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম, অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ প্রমুখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিতর্ক চর্চা শুরু করেন। এই প্রক্রিয়ায় নাম না জানা আরও অনেকে তাদের সঙ্গী ছিলেন। এর পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে বিতর্কের চর্চা শুরু হয়েছিল। তবে এই চর্চা সনাতনী বিতর্কে হত। ধীরে ধীরে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক নানা ধরণের বিতর্ক-বিতর্ক সংস্কৃতিকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে কম বেশী ১২ ধরণের বিতর্ক প্রচলিত।
১। সনাতনী বিতর্ক
নামই বলছে এটিই সবচেয়ে পুরানো ধারার বিতর্ক। এ বিতর্কের দু’টি পর্ব থাকে। একটি বিতর্কের বিষয় সংজ্ঞায়ন, যুক্তি প্রয়োগ ও খন্ডন নিয়ে বিতর্কের মূল পর্ব এবং অন্যটি যুক্তি খন্ডন পর্ব। দু’টি দলের মধ্যে এ বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয় এবং প্রত্যেক দলে তিনজন করে বিতার্কিক থাকে। বিতার্কিকদের অবস্থান হল পক্ষ দল-বিপক্ষ দল
পক্ষ দল
প্রথম বক্তা
দ্বিতীয় বক্তা
দলনেতা
বিপক্ষ দল
প্রথম বক্তা
দ্বিতীয় বক্তা
দলনেতা
প্রথম বক্তাঃ পক্ষ দলের প্রথম বক্তা বিষয়টিকে সুন্দরভাবে সংজ্ঞায়ন করবেন, বিষয়ের পক্ষে দলের অবস্থান স্পষ্ট করবেন এবং সম্ভাব্য দুএকটি যুক্তি খন্ডন করবেন। অন্যদিকে বিপক্ষ দলের প্রথম বক্তা পক্ষ দলের প্রথম বক্তার দেয়া সংজ্ঞায়নের মেনে নেয়া অংশ বাদে যদি প্রয়োজন হয় বাকী মূল শব্দগুলোর সংজ্ঞায়ন করবেন, বিষয়ের বিপক্ষে দলের অবস্থান স্পষ্ট করবেন এবং১ম বক্তার দু’চারটি যুক্তি খন্ডন করবেন।
দ্বিতীয় বক্তাঃ পক্ষ দলের দ্বিতীয় বক্তা বিপক্ষ দলের প্রথম বক্তার দেয়া দলীয় কৌশল ও অবস্থানের ব্যাখ্যা এবং তা খন্ডন করে বিভিন্ন তথ্য, তত্ত্ব, যুক্তি ও উদাহরণের মাধ্যমে প্রথম বক্তার দেয়া দলীয় অবস্থান আরও স্পষ্ট করে যাবেন। অন্যদিকে বিপক্ষ দলের দ্বিতীয় বক্তাও পক্ষ দলের দ্বিতীয় বক্তার ন্যায় তার দলের পক্ষে বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট করবেন।
দলনেতাঃ পক্ষ দলের দলনেতা তার প্রথম ও দ্বিতীয় বক্তার বক্তব্যের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে বিভিন্ন তথ্য, তত্ত্ব, যুক্তি ও উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টিকে তার দলের পক্ষে প্রমাণ করে যাবেন। অন্যদিকে বিপক্ষ দলের দলনেতাও তার দলের পক্ষে বিষয়টিকে প্রমাণ করে যাবেন।
যুক্তি খন্ডন পর্বঃ পক্ষ দলের দলনেতা বিপক্ষ দলের তিনজন বক্তার প্রদত্ত যুক্তিগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ যুক্তিগুলো ধরে ধরে খন্ডন করে তাদের যুক্তিকে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করবেন। অন্যদিকে বিপক্ষ দলের দলনেতাও পক্ষ দলের প্রদত্ত যুক্তিগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ যুক্তিগুলো খন্ডন করে তাদের যুক্তিকে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করবেন।
বিতর্কের সময় আয়োজক কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করবেন। তবে তা সাধারণত বিতর্কের মূল পর্বের জন্য প্রত্যেক বক্তা ৩- ৫ মিনিট করে (এক মিনিট পূর্বে সতর্ক সংকেত বাজাতে হবে) ও যুক্তি খন্ডন পর্বে উভয় দলের দলনেতা ২ মিনিট করে সময় পাবেন (দেড় মিনিটে সতর্ক সংকেত বাজাতে হবে)।
সনাতনী বিতর্কে সাধারণত সংজ্ঞায়ন, উচ্চারণ, বাচনভঙ্গি, তথ্য, তত্ত্ব ও উদাহরণ প্রদান, যুক্তি প্রয়োগ ও খন্ডন প্রভৃতি বিষয়ে নাম্বার প্রদান করা হয়ে থাকে।
২। বারোয়ারী বিতর্ক
বিতর্কের সবচেয়ে শিল্পিত ধারার নাম বারোয়ারী বিতর্ক। এ বিতর্কে পক্ষ- বিপক্ষ থাকে না। প্রত্যেকে স্বাধীন ভাবে নিজের মনের জানালা খুলে ভাবতে পারে। ভাবনার অভিনবত্ব ও সৃষ্টিশীলতা এ বিতর্কের প্রাণ। এ ধারার বিতর্কের বিষয়গুলোও হয় একটু ভিন্ন ধরণের- যেমন- ‘এসো নতুন সূর্য রচনা করি’- এক্ষেত্রে বিতার্কিক তার ইচ্ছে মত সূর্য বিশ্লেষণ করতে পারে স্বপ্ন দেখতেপারে/স্বপ্নে আসে শুধু ইত্যাদি।
- প্রথমেই সভাপতিকে ধন্যবাদ দিয়ে বিষয়ের উপর ভিত্তি করে সুন্দর ও সৃজনশীল একটি স্ট্যান্ড পয়েন্ট দাঁড় করাতে হবে।
- স্ট্যান্ড পয়েন্টটি দাঁড় করানোর পর বিষয়ের সাথে তার একটি সুন্দর সম্পর্ক দাঁড় করাতে হবে।
- এরপর বিভিন্ন যুক্তি ও কৌশল অবলম্বন করে বিষয়টিকে প্রদত্ত স্ট্যান্ড পয়েন্টের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করতে হবে।
- কোন অবস্থাতেই একাধিক স্ট্যান্ড পয়েন্ট নেয়া যাবে না এবং প্রদত্ত স্ট্যান্ড পয়েন্টের বাইরেও যাওয়া যাবে না। বিভিন্ন উদাহরণ আসলেও তা স্ট্যান্ড পয়েন্টের সাথে সম্পর্কিত করতে হবে।
- এ বিতর্কে বিষয়, আবেগ ও শব্দচয়নের মধ্যে একটি সুন্দর সামঞ্জস্য তৈরী করতে হবে। শব্দ চয়ন হতে হবে চমৎকার বিষয় ও স্ট্যান্ড পয়েন্ট যেভাবে দাবী করে সেভাবে আবেগ দিয়ে তা প্রকাশ করতে হবে।
৩। সংসদীয় বিতর্ক
বর্তমান সময়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় মডেল সংসদীয় বিতর্ক। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউস অব কমন্সের অনুসরণে এ বিতর্ক করা হয়। সনাতনী বিতর্কের মত এ বিতর্কেও দু’টি দলে ৬ জন বিতার্কিক অংশ নেন। পক্ষদল সরকারী দল এবং বিপক্ষ দল বিরোধী দল হিসেবে বিতর্কে অবতীর্ন হয়। সরকারী দলের ৩ বিতার্কিক প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য এবং বিরোধী দলের ৩ বিতার্কিক বিরোধী দলীয় নেতা, উপনেতা ও সংসদ সদস্য হিসেবে বিতর্কে অংশগ্রহণ করে। মডারেটরকে স্পীকার হিসেবে সম্বোধন করতে হয়। সংসদীয় বিতর্ক অল্প সময়েই প্রবল জনপ্রিয় হয়ে উঠার মূল কারণ হল এ ধারার বিতর্কের প্রাণ- পয়েন্টসমূহ। সংসদীয় ধারার বিতর্কে তিন ধরনের পয়েন্ট উত্থাপিত হয়- পয়েন্ট অব অর্ডার, পয়েন্ট অব প্রিভিলেজ এবং পয়েন্ট অব ইনফরমেশন
৪। জাতিসংঘ মডেল বিতর্ক
এই বিতর্কে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সমস্যা- সম্ভাবনা এবং সমস্যার সমাধান কল্পে উদ্ভূত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। সাধারণ পরিষদে যেমন- প্রত্যেক দেশের প্রতিনিধি থাকে ঠিক তেমনি এই বিতর্কে তার্কিকরা নির্দিষ্ট একটি দেশের প্রতিনিধি হিসেবে নিজ দেশের পররাষ্ট্রনীতির আলোকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বিভিন্ন সমস্যা এবং এর সমাধানকল্পে করণীয় বিষয়গুলো তুলে ধরেন। একজন সভাপতি পুরো বিতর্কটি মডারেট করেন এবং তার্কিকরা বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি হিসেবে নিজ দেশকে প্রতিনিধিত্ব করেন।
৫। টি- ফরমেট বিতর্ক
এটি পার্লামেন্টারী বিতর্কের মতই। এখানে চারটি দল অংশগ্রহণ করে। প্রত্যেক দলে ২জন বিতার্কিক থাকেন। দলগুলোকে সরকারী দল ১, সরকারী দল ২, বিরোধী দল ১ এবং বিরোধী দল ২ বলে। পার্লামেন্টারী বিতর্কের মতই সব নিয়ম এখানে প্রযোজ্য। তবে সরকারী দল ২ সরকারী ১ এর সংজ্ঞা ও বিশে¬ষণ তাদের দলীয় অবস্থান থেকে নতুনভাবে করতে পারবেন। অনুরূপ বিরোধী দলেরও এই সুযোগ থাকছে।
৬। প্লানচ্যাট বিতর্ক
বিতর্কের এই রূপটি প্রতিযোগিতার জন্য নহে। সাধারণত Show Debate হিসেবে এই বিতর্ক করা হয়। খুবই রোমাঞ্চকর এই বিতর্ক। এই বিতর্ক করতে পরিবেশটি লাগে আলো- আঁধারের মত। সচরাচর মোম জ্বালিয়ে কিংবা মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে বিতর্ক মঞ্চটি সাজানো হয়। আলো- আঁধারের মধ্যে বিতার্কিকরা বসে থাকেন। অথবা মঞ্চের পেছনেও থাকতে পারেন। এই বিতর্কটি অতীত ও বর্তমানের আলোচিত কিছু চরিত্র (ইতিবাচক- নেতিবাচক) নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। একে একে বিভিন্ন চরিত্র এসে তাদের কৃতকর্মের বর্ণনা দেন এবং শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দেয়ার চেষ্টা করেন। একজনের বিতর্ক শেষে উপস্থিত দর্শকসারি থেকে উক্ত তার্কিককে প্রশ্ন করা যাবে- তার চরিত্র বা কৃতকর্ম সংশ্লিষ্ট। মৃত বা জীবিত দু’ধরণের চরিত্রই প্লানচ্যাট বিতর্কে উপস্থিত হয়। এই বিতর্কে সবচেয়ে মজার কাজটি করে থাকেন বিতর্ক মডারেটর। যিনি পর্দার আড়াল থেকে পুরো বিতর্কটি পরিচালনা করে উপভোগ্য করে তোলেন। এই বিতর্কে যিনি মডারেটরের দায়িত্ব পালন করেন তাকে ‘ওঁঝা’ বলা হয়।
৭। রম্য বিতর্ক
সাধারণতঃ বিতর্ক অনুষ্ঠানে দর্শক- শ্রোতা মনোরঞ্জনের জন্য প্রীতি বিতর্ক হিসেবে রম্য বিতর্কের আয়োজন করা হয়। একটু চটুল বিষয় নির্ধারণ করা হয় এ ধরণের বিতর্কে। যেমন- “মন নয় চাই মোটা মানিব্যাগ, সম্পর্কের ক্ষেত্রে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের ত্যাগ বেশী।” এবং বিতার্কিকরাও এই বিতর্কে হাস্যরসাত্মক ভাবে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
সনাতনী ও সংসদীয় উভয় ফরমেটে রম্য বিতর্ক করা হয়।
৮। আঞ্চলিক বিতর্ক
আঞ্চলিক বিতর্ক রম্য বিতর্কেরই একটি ধারা। বারোয়ারী ফরমেটে এ বিতর্কে প্রত্যেক বিতার্কিক নির্দিষ্ট অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষায় বিতর্ক করে থাকে। যেমন, একটি বিতর্কে ৬ জন বিতার্কিক যথাক্রমে বরিশাল, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, সিলেট, ঢাকা (অবশ্যই পুরান ঢাকাইয়্যা) ও দিনাজপুরের আঞ্চলিক ভাষায় বিতর্ক করতে পারে। এ বিতর্কে বিতার্কিক সংখ্যা যে কোন সংখ্যার হতে পারে।
৯। জুটি বিতর্ক
এই বিতর্কটিও ‘শো- ডিবেট’ হিসেবে জনপ্রিয়। জীবিত অথবা মৃত বাস্তব জুটি, অথবা সিনেমা, নাটক, কিংবা উপন্যাসে জনপ্রিয় কোন জুটির ভূমিকায় ২ জন করে এ বিতর্কে অংশ গ্রহণ করে। জুটি সংখ্যা যে কোন মাত্রার হতে পারে, যেমনঃ দেবদাস- পার্বতী, অমিত- লাবণ্য, ডি ক্যাপ্রিয়- উইন্সলেট, বাকেরভাই- মুনা ইত্যাদি চরিত্রে বিতর্ক হয়। তারা প্রত্যেকে নিজেদের ত্যাগকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করে।
ইংরেজী মাধ্যমে বিতর্কঃ
আলোচিত ৯ ধরণের বিতর্কের মধ্যে আঞ্চলিক বিতর্ক ছাড়া বাকী ৮ ধরণের বিতর্কই ইংরেজী মাধ্যমে করা যেতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে ইংরেজী মাধ্যমে ৩ ধরণের বিতর্ক হয়।
১০। Traditional Formate
সনাতনী ধারার বিতর্কের সব নিয়ম নীতি মেনে Traditional Formate এর বিতর্ক হয়।
১১। Parliamentary Formate
ইংরেজী মাধ্যমে Parliamentary Formate কেই বাংলা মাধ্যমে সংসদীয় বিতর্ক বলা হয়ে থাকে। নিয়ম নীতি একই শুধু ভাষা ভিন্ন।
১২। World’s Formate
International Debate Compitition যে ফরমেটে অনুষ্ঠিত হয় তাকে World’s Formate বলে। এই বিতর্কে একই সাথে একই বিষয়ে ৪টি দল অংশগ্রহণ করে। প্রতি দলে বিতার্কিক থাকেন ২জন। তারা Gov- 1, Gov- 2, Opp- 1, Opp- 2নামে পরিচিত হয়।
আলোচিত ১২ ধরণের বিতর্কের বাইরেও বিতর্ক থাকতে পারে। তবে প্রতিযোগিতা মূলক বিতর্কে সনাতনী, বারোয়ারী ও সংসদীয় বিতর্ক হয়। অন্যান্য ফরম্যাটগুলো বিতার্কিকদের আকৃষ্ট করার জন্য বা নতুনদের এই শিল্পটির সাথে পরিচিত করার জন্য আয়োজন করা হয়ে থাকে। এই শিল্পটির অব্যাহত চর্চাই পারে আগামী প্রজন্মকে ‘নতুন বাংলাদেশ’ উপহার দিতে। শক্তির জোর নয় যুক্তির জোর দিয়ে সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মানে বিতার্কিকরা অগ্রণী ভূমিকা রাখবে সেই স্বপ্ন আমরা দেখতেই পারি
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
মোঃ রাশেদুল আলম রাসেল
সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি, ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটি
History বললে ভালো হত
ReplyDelete